আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেওয়া নিশ্চিত করতে ‘যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ’ চেয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের দেওয়া বক্তব্য নিয়ে রাজনীতিতে তোলপাড় চলছে। বিদেশিদের কাছে প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ চেয়ে এভাবে দেশের কোনো মন্ত্রী অতীতে বক্তব্য দিয়েছেন কী না, এ প্রশ্ন সামনে আসছে। রাজনীতিতে বিদেশিদের হস্তক্ষেপের বিষয়ে ‘কঠোর ও সতর্কনীতি’ অনুসরণের কথা বলে আসছে সরকার। এ সরকারের মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ এক সদস্যের এমন বক্তব্যের তাই চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে।
গত সোমবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিংকেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ‘বিএনপিকে নির্বাচনমুখি করতে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ’ চান আব্দুল মোমেন। এরপর গত প্রায় চারদিনের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজের বক্তব্যের বিষয়ে আর কোনো ব্যাখ্যা দেননি। যুক্তরাষ্ট্রে সফররত আব্দুল মোমেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠককালে ‘নিজে একসময় রাষ্ট্রহীন’ থাকার কথা উল্লেখ করেন। তাঁর এ দাবি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
আনুষ্ঠানিক বৈঠকে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘তিনি ব্যক্তিগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ঋণী। যখন তিনি রাষ্ট্রহীন, গৃহহীন ও বেকার ছিলেন, তখন দেশটি তাঁকে আশ্রয় দিয়েছে।’ কোনো দেশেই যখন কারো নাগরিকত্ব থাকে না, তখন সেই ব্যক্তি রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়েন। দেশের নাগরিকত্ব আইনে ২০১৬ সালে কিছু সংশোধনী যুক্ত করার আগপর্যন্ত জন্মসূত্রে নাগরিক, এমন কারো নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার সুযোগ ছিল না। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত কারো নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছে কোনো সরকার- এমন নজিরও নেই। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নাগরিকত্ব কখন বাতিল করা হয়েছিল, তা তিনি বক্তব্যে স্পষ্ট করেননি।
সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের সূত্র শুক্রবার সন্ধ্যায় মত ও পথকে জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কয়েকবার মন্ত্রীদের কম কথা বলার পরামর্শ-নির্দেশনা দিলেও কোনো কাজ হয়নি। কোনো কোনো মন্ত্রীর বেফাঁস কথায় তাঁরা নিজেও ‘বিপদে’ পড়ার পাশাপাশি প্রায়ই সরকারকেও ‘বিব্রতকর অবস্থার’ মুখোমুখি করেন।
ড. মোমেনের ‘স্ববিরোধী বক্তব্যে’ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব ও দলটির নেতৃত্বের সরকার ‘বিব্রত’। ‘যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ’ চাওয়ার বিষয়টিকে দল ও সরকার মন্ত্রীর ‘ব্যক্তিগত বক্তব্য’ বলে দাবি করছে। তারা এ বক্তব্যের দায় নিতে রাজি নয়। আওয়ামী লীগের শরিক দলের শীর্ষনেতারাও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য ‘দেশের জন্য লজ্জাকর’ বলে মনে করছেন।
কূটনৈতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মতে, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই প্রস্তাব, বা আহবান দেশের জন্য ‘বিপজ্জনক’। বিশেষ করে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তনয়া ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের আত্মমর্যাদাশীল পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশিদের হস্তক্ষেপের বিষয়ে তাঁর সরকারের কঠোরনীতি দেশে-বিদেশে আলোচিত ও প্রশংসিত।
মত ও পথের পর্যালোচনা বলছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই বক্তব্য ‘স্ববিরোধী’। কারণ, মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি একাধিকবার বিদেশি কূটনীতিকদেরকে এ দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ না করতে সতর্কতা দেন। কখনো কখনো কড়া বক্তব্যও দেন মন্ত্রী।
কারাবন্দী লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুতে বিদেশি কূটনীতিকদের ভূমিকার সমালোচনা করে গত বছরের ১ মার্চ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশ একটা তাজ্জবের দেশ। কেউ একজন মারা গেলেই সে কেন মারা গেল, এটা নিয়ে তাঁরা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।’
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন উপলক্ষে ঢাকায় নিযুক্ত কয়েকটি দেশের কূটনীতিক ব্রিটিশ হাইকমিশনে মিলিত হন বলে দেশীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৩০ জানুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘বিদেশিদের নাকগলানোয়’ বিরক্তি প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, ‘কূটনীতিকরা নিজের কাজ বাদ দিয়ে আমাদের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে নাক গলাচ্ছেন। এটা উচিত নয়। যাঁরা কোড অব কন্ডাক্ট মানবেন না, তাঁদেরকে দেশ থেকে চলে যেতে বলা হবে।’
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে মোমেনের সহযোগিতা চাওয়ার সমালোচনা করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে আওয়ামী লীগই বিদেশিদের কাছে ধরনা দেয়। অথচ এই লোকগুলোই সারাক্ষণ কথা বলতে থাকেন, আমরা (বিএনপি) বিদেশিদের সাহায্য নিয়ে কাজ করি।’
মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শুক্রবার বিবৃতি দেন বলে বাসসের খবরে বলা হয়। এতে তিনি বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচন হবে। নির্বাচনে কাউকে আনা, না আনা সরকারের দায়িত্ব নয়। আইন অনুযায়ী, নির্বাচন পরিচালনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ওপর ন্যস্ত।’
‘বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিতে মার্কিন কর্তৃপক্ষকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুরোধ একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত’ বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘তাঁর বক্তব্য একান্তই ব্যক্তিগত। সরকারের, বা আমাদের দলের বক্তব্য নয়।’
নিজের লেখা ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ বইকে ঘিরেও আলোচনার জন্ম দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ওই বইয়ের ১৬ পৃষ্ঠায় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ‘ভূয়সী প্রশংসা’ করেন তিনি। সিপিবির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, প্রবীণ রাজনীতিক হায়দার আকবর খান রনো সম্প্রতি গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেন, মন্ত্রীর ওই বইয়ে তাঁর সম্পর্কে ‘অবান্তর ও ভুল তথ্য’ আছে। তা ‘শুধু ভুলই নয়, অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ উল্লেখ করে রনো বইটি থেকে তাঁর সম্পর্কে বক্তব্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানান।