যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বযুদ্ধে জড়ানোর পাকে পুনরাবৃত্তি

অ্যাডাম টুজ

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ
প্রতীকী ছবি

ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধের শুরুর দিকে ওয়াশিংটন ডিসিকে মনে হয়েছিল ইতিহাসের ভূতে আক্রান্ত। এখন ইউক্রেনকে দ্রুত সহায়তা করার জন্য মার্কিন কংগ্রেস ‘ইউক্রেন ডেমোক্রেসি ডিফেন্স লেন্ড-লিজ অ্যাক্ট ২০২২’ পাস করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ১৯৪১ সালে ফ্রাংকলিন ডি রুজভেল্ট ঠিক এটাই করেছিলেন, যে আইনের অধীনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, চীন ও গ্রিসকে সামরিক ও অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছিল।

বর্তমানে ওয়াশিংটনে ইউক্রেনকে সহায়তা করার জন্য যে পরিমাণ অর্থের কথা ভাবা হচ্ছে তা বিশাল।

এর পরিমাণ মোট চার হাজার সাত শ কোটি মার্কিন ডলার, যা যুদ্ধপূর্ব ইউক্রেনের জিডিপির এক-তৃতীয়াংশের সমান। এখন সহায়তার বিষয়টি যদি মার্কিন কংগ্রেসে অনুমোদিত হয়, সেটা হবে পশ্চিমা সহায়তার সর্বোচ্চ। এর অর্থ হচ্ছে, আমরা একটি সম্পূর্ণ যুদ্ধের চেয়ে মোটেও কম অর্থ ব্যয় করছি না।

লেন্ড-লিজ হচ্ছে একটি যুদ্ধকালীন হস্তক্ষেপ কৌশল। এর অধীনে অতীতে যেসব সামগ্রী দেওয়া হয়েছিল, তার বেশির ভাগই ছিল অস্ত্রশস্ত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে উত্তর আফ্রিকার মরুভূমিতে মন্টিস আর্মি লেন্ড-লিজের অধীনে শেরম্যান ট্যাংক দিয়ে লড়াই করেছিল। ১৯৪২ সালের পর গ্রেট সোভিয়েত বাহিনীর প্রতি-আক্রমণগুলো লেন্ড-লিজের ট্রাক দিয়েই পরিচালিত হয়েছিল।

এই কৌশলকে এত অসামান্য করে তোলার কারণ হলো, ১৯৪১ সালের মার্চ মাসে লেন্ড-লিজ কর্মসূচিটি চালু হওয়ার সময় যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লিপ্ত হয়নি। কিন্তু লেন্ড-লিজ কর্মসূচি ছিল এমন নীতিনির্ধারণী মুহূর্ত, যার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে না গেলেও নিরপেক্ষতা ত্যাগ করেছিল। বৃহত্তর পরিভাষায় এটি বিশ্বনেতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের উত্থানকে ত্বরান্বিত করেছিল। বিষয় হচ্ছে, ভালো-মন্দ যা-ই হোক, এটি আজও রয়ে গেল।

সম্ভবত লেন্ড-লিজের বর্ণনার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদার পৃষ্ঠপোষকতায় খারাপ শাসনের বিরুদ্ধে মহান যুদ্ধের বিজয়কে বোঝানো হয়। কিন্তু এই বর্ণনার চৌহদ্দি পরিপূর্ণ করার জন্য আপনাকে ১৯৪১ সালের মার্চের লেন্ড-লিজ থেকে আগস্টের আটলান্টিক সনদ এবং ডিসেম্বরের মধ্যে পার্ল হারবারে আক্রমণ ও যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশের দিকে এগিয়ে যাওয়ার দিকে চোখ রাখতে হবে। কারণ চীন ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্য উভয়কে সহায়তা দিয়ে লেন্ড-লিজ কর্মসূচিটি মূলত চীনের বিরুদ্ধে জাপানের একটি পৃথক যুদ্ধকে এবং ইউরোপের জার্মান যুদ্ধকে বিশ্বযুদ্ধে পরিণত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। এখন মার্কিন কংগ্রেস যদি একটি নতুন লেন্ড-লিজ কর্মসূচি চালু করে, তাহলে ইউক্রেন যুদ্ধে তীব্রতা বৃদ্ধির বিষয়টি তার পরিকল্পনার অংশ কি না সেটা অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে।

এই সময়ে এসে এফডিআরের (ফ্রাংক ডেলানো রুজভেল্ট) বন্ধু ও সমালোচক উভয় পক্ষই সব সময় জোর দিয়ে বলে যে নািস জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধকে উসকে দেওয়াই ছিল লেন্ড-লিজের লুকানো এজেন্ডা। হয়তো আজকের বেশির ভাগ ইতিহাসবিদ এই যুক্তি দেবেন যে আমাদের প্রেসিডেন্টের উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট ছিল না। এমনকি পার্ল হারবারে আক্রমণ করার পরও রুজভেল্ট জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার জন্য কংগ্রেসে সংখ্যাগরিষ্ঠতা খুঁজে পাবেন কি না তাও স্পষ্ট ছিল না।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর পুতিন তাঁর পারমাণবিক অস্ত্রে শাণ দেন। এখন বাইডেন যদি একটি বিশাল লেন্ড-লিজ স্টাইলের সহায়তা প্যাকেজকে আইনে পরিণত করেন, তাহলে কে বলতে পারবে যে রুশ প্রেসিডেন্ট এর জবাব কিভাবে দেবেন? আরো প্রশ্ন আছে, ইউক্রেনকে কি শুধু পুতিনের সেনাবাহিনীকে বিতাড়িত করার জন্য অস্ত্র দেওয়া হবে? নাকি আমরা কিয়েভকে রাশিয়ার ওপর হামলা চালানোর জন্য সজ্জিত করব?

১৯৪১ সালে মূলত অ্যাংলো-আমেরিকান দৃষ্টিভঙ্গি ছিল জার্মানির শহরগুলোকে বর্জ্যে পরিণত করা এবং এর জনসংখ্যাকে বাড়িছাড়া করতে নজিরবিহীন কৌশল বোমা হামলা চালানো। কিন্তু অ্যাংলো-আমেরিকান অংশীদারির ক্ষেত্রে লাভের প্রত্যাশায় সহায়তা করার বড় একটি অংশ ছিল টিজার্ড মিশন। এর মাধ্যমে পারমাণবিক বোমা তৈরিসহ ব্রিটিশ ব্যাবহারিক জ্ঞান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তরিত হয়েছিল। একই সঙ্গে গণতন্ত্রের অস্ত্রাগার দিয়ে একটি ন্যায্য যুদ্ধে জয়লাভের মিষ্টি কথার পেছনে লুকিয়ে ছিল একটি সর্ববিধ্বংসী বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা।

১৯৪১ সালে আমেরিকার কংগ্রেসে রুজভেল্টের প্রতিপক্ষকে তাড়া করে বেড়ায় এই দুঃস্বপ্ন। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে দ্বিতীয় ভয়ানক সংঘাতে লিপ্ত হওয়া এবং বিশ্বব্যবস্থাকে সামরিকীকরণের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিল। এটি তখন দুর্বল কোনো অভিমত ছিল না। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, লেন্ড-লিজ অ্যাক্টের ২০২২ সালের সংস্করণটি এখন সর্বসম্মতিক্রমে সিনেটে পাস হলেও ১৯৪১ সালে সিনেটে এর বিপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ ভোট পড়েছিল।

রুজভেল্ট জানতেন যে আমেরিকার জনগণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয়। তিনি আশা করেছিলেন যে লেন্ড-লিজ অ্যাক্ট দিয়ে আমেরিকার অংশগ্রহণকে যুদ্ধ বলা থেকে বিরত রাখা যাবে। এ কারণেই ১৯৪১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চার্চিল একদিকে যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে প্রবেশ না করা, অন্যদিকে ব্রিটেন ও তার সাম্রাজ্যকে সামরিক সরঞ্জাম প্রদানেরও আহ্বান জানিয়েছিলেন এই বলে যে ‘আমরাই কাজটি শেষ করব’।

ঠিক এটাই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থান। এটা ঠিক যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা যৌক্তিক কারণে এমন একটি লড়াইয়ে এক পক্ষকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেখানে তারা সরাসরি জড়িত হবে না। আবার এটাও ঠিক যে আমরা এফডিআরের মতো কাজটা করছি, যাতে একটি চোখ রয়েছে আক্রমণের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধের প্রতি এবং আরেক চোখ রয়েছে ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যের প্রতি। এখন রাশিয়া যদি ইউক্রেনের পাথরের ওপর নিজেকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং যদি ইউক্রেনও যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক হয়, তবে তাই হোক।

আর এটাই যদি পরিকল্পনা হয় এবং পুতিন যদি আমাদের এই যুদ্ধে লেগে থাকার সুযোগ করে দেন, তাহলে অবশ্যই এর পক্ষে যুক্তি আছে। তবে একটি ঠাণ্ডা মাথার হিসাব হচ্ছে, আমরা যে এটিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অর্ধ-স্মরণীয় ইতিহাস দিয়ে সাজাতে চাই, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, যাতে সুখী সমাপ্তিকেই হিসাব করা হয়। তবে এর বিনিময়ে যে অবশ্যম্ভাবী বিসর্জনগুলো দিতে হয়েছিল, তা কখনো স্পষ্ট করা হয় না।

লেখক : যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান (যুক্তরাজ্য)

সংক্ষেপিত ভাষান্তর

শেয়ার করুন