রিকশার প্যাডেল ঘুরিয়েই জোটে শতবর্ষী রণজিতের খাবার, ফুটপাতে রাত যাপন

যশোর প্রতিনিধি

শতবর্ষী রণজিত ঘোষ
শতবর্ষী রণজিত ঘোষ। সংগৃহীত ছবি

চুল-দাড়ি পেকেছে অনেক আগেই, ভাজ পড়েছে চামড়ায়। রিকশা চালানোর যে শক্তি প্রয়োজন, তাও হ্রাস পেয়েছে। তবু প্রতিদিন রিকশার প্যাডেল ঘোরানোর যুদ্ধে চলে ৯৮ বছর বয়সী রণজিত ঘোষের জীবিকার চাকা।

জীবন সায়াহ্নে এসে আর কোনো উপায়ও নেই তার। রিকশা চালানোর আয়েই জোগাড় হয় তার তিনবেলার খাবার। তবে নেই তার মাথা গোঁজার ঠাঁই। তাই দিনশেষে ক্লান্ত শরীরে ফুটপাতে রাত যাপন করেন। এভাবেই কাটছে তার দিন।

রণজিত ঘোষের আদি বাড়ি যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার জামালপুর গ্রামে। তিনি দীর্ঘদিন যশোর শহরের বেজপাড়া এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। এক সময় হোটেলে বাবুর্চির কাজ করলেও এখন রিকশা চালান। স্বজন বলতে তার একমাত্র মেয়ের ঘরে নাতি রয়েছে। বিয়ে করে অন্য জায়গায় থাকে সে। তাই সারাদিন রিকশা চালিয়ে রাতে যশোর শহরের চৌরাস্তার ন্যাশনাল লাইফ ইনসুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের (এনএলআই টাওয়ার) ভবনের নিচে ফুটপাতে ঘুমান এ শতবর্ষী বৃদ্ধ।

রণজিত ঘোষ বলেন, ‘চার বছর বয়েসে মা মরে গেছে। সৎ মার গালিগালাজ শুনিছি ম্যালা। ১০ বছর বয়সে এই যশোরে আইয়েছি। বিভিন্ন হোটেলের বাবুর্চির কাজ করিছি। সৎ মারে আড়াল করে বাবা যশোরে আসে টুকটাক খোঁজ খবর নিতো। দেখেশুনে আমারে বিয়ে দিয়ার কয়দিন পরেই বাবা মরে গ্যালো। হিন্দুস্থান পাকিস্তান হওয়ার এক বছর পর আমার তিন ছেলে মরে গ্যাছে ডায়রিয়ায়। ওদের বয়স তখন পাঁচ বছরের কম। একটা মেয়ে ছিল। এখন বেঁচে আছে কি না জানিনে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মেয়েরে বিয়ে দিছিলাম। বিয়ের পরে ওর একটা ছেলে হলো। ছেলে হওয়ার দেড় মাস পরে বাচ্চাটকে নিয়ে আমার কাছে চলে আসলো মেয়ে। খুব কষ্টে মেয়ের নামে একটা বাড়িও কিনিছিলাম আকবরের মোড়ে (যশোর শহরের একটি জায়গা)। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে মেয়েটাও আমাকে ছেড়ে কোথায় যে চলে গ্যাছে তার খোঁজ আজও মেলেনি। ১১ বছর আগে আমার স্ত্রী মরে গেছে। মেয়ের রেখে যাওয়া দেড় মাসের ছেলেকে বড় করলাম, বিয়ে দিলাম। এখন আমার দুনিয়ায় এ রিকশা ছাড়া আর আপন বলতে কেউ নেই!’

রিকশা চালিয়ে আয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো কোনো দিন ৬০ টাকা, ৮০ টাকা, ১০০ টাকা বা ১৫০ টাকা আয় হয়। ব্যস্ততম সময়ে অধিকাংশ মানুষই আমার পায়ে টানা রিকশায় উঠতে চান না। যা আয় হয় তাই দিয়ে হোটেলে কোনো রকম দু’বেলা দুমুঠো খেয়ে দিন পার করছি। বাড়ি ঘর হারানোর পরে এক হাজার টাকার ভাড়া বাসায় একাই থাকতাম। রোজগার ভালো হয় না। তাই ভাড়া করা বাসা ছেড়ে এখন ফুটপাতে থাকি।’

জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকার আক্ষেপ করে রণজিত ঘোষ বলেন, ‘কতো নিতার কাছে গিলাম সবাই ফিরোয়ে দেছে। লাগবে না আইডি কার্ড। কী হবে এখন আর আইডি কার্ড দিয়ে!’

যশোরের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্বজন সংঘের সাধারণ সম্পাদক সাধন কুমার দাস বলেন, ‘শতবর্ষী রণজিত কুমারের জীবন সংগ্রাম যে কোনো হৃদয়বান মানুষকে স্পর্শ করবে। স্বজনহারা মানুষটির সংগ্রামের গল্প আমাকেও অশ্রুসিক্ত করেছে। তার সহায়তায় বিবেকবান মানুষের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।’

শেয়ার করুন