নিরন্তর কালের আবর্তনে আবার ফিরে এসেছে ১৫ অক্টোবর, ফিরে এসেছে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস’। ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর, সন্ধ্যার পর আকাশে প্রচণ্ড মেঘ, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর মাঝেমধ্যে সামান্য দমকা হাওয়া যেন বারবার জানান দিচ্ছিল ভয়াবহ এক মহাবিপদের সংকেত। কিন্তু যে যৌবন অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড দ্রোহ, সে যৌবনের কাছে তো সামান্য বৃষ্টি আর দমকা হাওয়া নিতান্তই তুচ্ছ।
জগন্নাথ হলের লাউঞ্জে তখন আনন্দ আমেজ। ঘরোয়া সান্ধ্য বিনোদন বলতে তখন বিটিভিই ছিল একমাত্র মাধ্যম, যার শ্রেষ্ঠ বিনোদন উপকরণ নাটক। তখন সাপ্তাহিক নাটকের সাথে সবে উপযোগ ধারাবাহিক নাটক। তখন ‘ঢাকায় থাকি’ ধারাবাহিকের মুগ্ধতার আবেশ পেয়ে বসেছিল মানুষকে। রাত প্রায় ৯টা বা তার কাছাকাছি। তখনই ঘটে যায় ইতিহাসের সেই হৃদয় বিদারক অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, শামসুননাহার হল, রোকেয়া হলের অবস্থান পাশাপাশি। প্রায় প্রতিবেশীর মতো। রোকেয়া হলের লাউঞ্জে বসে নাটক শেষ করে আড়মোড়া ভেঙে সবে বাইরে বেরিয়েছি। ফায়ার বিগ্রেডের গাড়ির কর্কশ হর্ণ আর অ্যাম্বুলেন্সের সকরুণ আওয়াজ আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে শ্রবণেন্দ্রিয় যেন তছনছ করে দিচ্ছে। অজানা আতঙ্কে ঔৎসুক্য সবাই। দেশে তখন স্বৈরাচারী শাসন চলছে। কোথাও তো কোনো কিছুর ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে? যা ভাবা যায় না তাও হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে জানা গেল, জগন্নাথ হলের ছাদ ধ্বসে অনেক ছাত্র মারা গেছে। আহত হয়েছে তারও কয়েকগুণ। বুক ভেঙে যাওয়া হৃদয় চূর্ণ করা সে খবর!
পরে জানা যায়, ছাত্র, কর্মচারী ও বহিরাগতসহ সেদিন জীবন বিসর্জন হয়েছিল ৩৯ জনের। আহত হয়েছিলেন প্রায় ৩০০ জনের মতো। যদি না সেদিন নাটকের কারণে টিভি হল রুমে সবাই একত্রিত হতো তবে হয়ত এতগুলো জীবন একসাথে হারিয়ে যেত না। সেদিন স্তদ্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রকৃতি। ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারীসহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার হয়েছিল বাকরুদ্ধ। তাদের সাথে কেঁদেছিল সারা দেশ। দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক একজন সম্ভাবনাময় ছাত্র সে তো দেশের সূর্য সন্তান। তাদের এই অসহায় চলে যাওয়া কেউ কি পারে মেনে নিতে? সারা দেশে পালিত হয়েছিল শোক। এমনই একটি অধ্যায়ের অভিজ্ঞতা নিতে সেদিন প্রস্তুত ছিল না কেউ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুকে প্রতি বছর ১৫ অক্টোবর আসে এক মর্মান্তিক শোকের স্মৃতি হয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে জগন্নাথের আঙ্গিনায় শরতের কাশের দোলা যেন আসে মর্মান্তিকতার আঘাত হয়ে।