মাছে-ভাতে বাঙালি : সৈয়দ শিশির

‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ এ অঞ্চলের প্রচলিত প্রবাদ। এ প্রবাদের যৌক্তিক কারণও ছিল। এমন একটা সময় ছিল যখন বাঙালির ঘরে গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা দুধের গরু ছিল। তখন যেকোনো দম্পতিকে আশীর্বাদ করার সময় বলা হতো, ‘দীর্ঘজীবী হও বৎস দুধে, মাছে, ভাতে।’ কিন্তু আজ হারিয়ে গেছে সেই দিনগুলো। নদী আর পুকুরভরা মাছের দেশ বাংলাদেশ এখন প্রায় খাল-বিল-নদী-নালাশূন্য। বর্তমানে মৎস্যচাষিরাও এমন প্রজাতির মাছ চাষ করছেন, যেগুলো দ্রুত বর্ধনশীল। বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক এসব মাছের চাষ এবং উন্মুক্ত জলাশয়ে দেশি মাছ চাষের ব্যাপারে অনীহার কারণে আমরা হারিয়ে ফেলছি দেশীয় প্রজাতির নানা মাছ।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দিন দিন কমছে আমাদের ফসলি জমি ও ফসল। অথচ একসময় আমাদের মাতৃভূমি সোনার বাংলার ক্ষেত-খামার সোনালি ফসলে পরিপূর্ণ থাকত। একই সঙ্গে দেশের নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুর-ডোবায় প্রবহমান ছিল প্রচুর পরিমাণ মিঠাপানি। যে প্রবাহে জলাশয়গুলো ব্যবহূত হতো সুস্বাদু মাছের চারণভূমিরূপে। সেই নদীর দেশ আর পুকুরভরা মাছের দেশ বাংলাদেশ এখন প্রায় খাল-বিল, নদী-নালা শূন্য। খাল-বিল ভরাট করে চলছে নানা স্থাপনা তৈরির মহোৎসব। আর যেসব এখনো অবশিষ্ট রয়েছে, সেগুলোতে দূষণের মাত্রা এত বেশি যে মাছের পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন। এ ছাড়াও কৃষিজমিতে ব্যবহার করা কীটনাশক বৃষ্টির পানি বা সেচের মাধ্যমে বিল ও জলাশয়গুলোতে গিয়ে পড়ায় মাছের বেঁচে থাকার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট নানা কারণে দিন দিন বিলুপ্ত হচ্ছে আমাদের চেনা-অচেনা মাছগুলো। অথচ আজো বলা হয় ‘মাছে-ভাতে’ বাঙালি। কবি ঈশ্বর গুপ্ত বলেন, ‘ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙ্গালি সকল/ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল।’

বাঙালির জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে মাছ আর মাছ। জন্ম-বিবাহ-মৃত্যু সবকিছুতেই কম-বেশি মাছের উপস্থিতি লক্ষণীয়। বাঙালিরা মাছ খাওয়ার উপযোগী করেন সেঁকে, সামান্য পুড়িয়ে, ঝোল ঝালে, ভেজে, ভাপে সিদ্ধ করে, ভর্তা বানিয়ে, বড়া বানিয়ে কিংবা কোফতা করে। আবার বিভিন্ন মাছের সঙ্গে আলাদা সবজি দেওয়ার পদ্ধতিও তাদের জানা আছে। কিন্তু ঠিক কবে থেকে বাংলাদেশে মাছ খাওয়া শুরু, তার কোনো সঠিক তথ্য জানা যায় না। তবে এটুকু বোঝা যায়, হাওর-বাঁওড় আর খাল-বিল, নদী-নালার বাংলাদেশে মাছ সেই আদি যুগ থেকেই খাওয়া হতো। কারণ চন্দ্রকেতু গড়ে পাওয়া চতুর্থ শতকের পোড়ামাটির ফলকটিতে মাছ উৎকীর্ণ রয়েছে। তারপর অষ্টম শতাব্দী থেকে বাংলাদেশের পাহাড়পুর ও ময়নামতি থেকে যেসব পোড়ামাটির ফলক উদ্ধার করা হয়েছে, তার বেশ কয়েকটিতেও মাছের দৃশ্য দেখা যায়। মাছ যে বাঙালির অতি প্রাচীন এক জনপ্রিয় আহার্য বস্তু, এ ফলকগুলো তারই পরিচায়ক।

মাছ বাঙালির জন্য সুস্বাস্থ্যের ভান্ডার এবং প্রজননশক্তির প্রতীক। স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য সমাজের ধনিক ও অভিজাত শ্রেণির মানুষ ছোট মাছের প্রতি আকৃষ্ট না হলেও গ্রামের সাধারণ মানুষের আমিষের প্রধান উৎস কিন্তু ওই ছোট মাছ। মলা, ঢেলা, চেলা, টেংরা, পুঁটি, কাচকি মাছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, জিঙ্ক, আয়োডিন, মিনারেল, ফসফরাস ও ভিটামিন-এ থাকে। বিশেষ করে মলা ও ঢেলা মাছে তো থাকে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন-এ, যা বাড়ন্ত শিশুদের ‘জেরক থালমিয়া’ রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। জানা যায়, ভিটামিন-এ’র অভাবে গড়ে প্রতিবছর ৩০ হাজার শিশু অন্ধত্ববরণ করে। এ ছাড়া মা ও শিশুর রক্তশূন্যতার অভাব ছোট মাছের দ্বারা পূরণ করা যায় সহজেই। মাছের প্রোটিন অন্যান্য প্রাণিজ প্রোটিনের মতোই রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। মাছে যে ওমেগা ও ফ্রি ফ্যাট অ্যাসিড থাকে, তা রক্তের অণুচক্রিকাকে রক্তজমাট বাঁধতে দেয় না। বিশেষ করে মলা, ঢেলা, রিটা, শিং, মাগুর, কৈ মাছ চোখের জন্য অত্যন্ত উপকারী।

বাঙালির সাহিত্যে মাছ চলে সাঁতরে। মঙ্গল কাব্যের পাতায় পাতায় মাছ রান্নার সৌরভ ম ম করে ভেসে বেড়ায়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যেও মাছ ও মাছ ধরা জেলে জীবনের রয়েছে অনুপম চিত্র। ইংরেজি সাহিত্যে তপসে মাছের নাম ও স্বাদ নিয়ে বেশকিছু আলোচনা রয়েছে। ইলিশ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ তেমন কিছু না লিখলেও মাছের কত প্রসঙ্গ যে উপন্যাসে, ছড়ায়, কবিতায়, ছবিতে আর চিঠিপত্রে এনেছেন, তার শেষ নেই। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর তার আত্মজীবনী ‘তুজুক’-এ লিখে গেছেন, মালব থেকে গুজরাটে যেতে পথে সর্দার রায়সান তাকে একটা বড় রুই মাছ দেন। বহুদিন পর একটি ভালো রুই পেয়ে বাদশা এত খুশি হলেন যে, তখনই তিনি সর্দারকে একটি উৎকৃষ্ট ঘোড়া উপহার দিলেন। বাঙালির প্রবাদ-প্রবচন আর প্রতিদিনের কথায়ও মাছের স্বভাব-চরিত্র নিয়ে বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্যের ছড়াছড়ি। আমরা যখন বলি অমুক ব্যক্তি সাক্ষাৎ ‘রাঘব বোয়াল’, তখন শ্রোতার এই কথার মর্ম বুঝতে সমস্যা হয় না। ঠিক তেমনি ‘গভীর জলের মাছ’, ‘মাছের মা’, ‘মাছের তেলে মাছ ভাজা’, ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’, ‘ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না’ অথবা ‘মাছের মায়ের পুত্রশোক’ প্রবচনগুলো দিয়ে অনেক কথাই বোঝানো হয়।

দুই যুগ আগেও আমাদের নদী-নালা ও খাল-বিলগুলোতে দেশীয় মাছের প্রাচুর্য ছিল। প্রত্যেক পরিবারের পুকুরগুলো নানা প্রকার মাছে পরিপূর্ণ ছিল। বর্ষার আগমনে এসব মাছ মহোৎসবে নদী, নালা, খাল, বিল, পুকুর, ডোবায় মাছের ছলাৎ, ছলাৎ শব্দে মুখর হয়ে উঠত। হাওর-বিলে মাছের খেলায় দর্শক মাত্রই বিমোহিত হতো। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে চারণভূমি ও পানির অভাবে অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়েছে। একই সঙ্গে কীটনাশক, রাসায়নিক সার ও কারেন্ট জাল ব্যবহারের ফলে মাছের জাত ধ্বংস হচ্ছে। কিছু সংখ্যক মাছ এখনো হাট-বাজারে দৃশ্যমান হলেও তা ক্রেতা সাধারণের নাগালের বাইরে। বর্তমানে সাগর হতে স্বাদবিহীন আহূত মৎস্য দ্বারা দেশের চাহিদা পূরণ করতে হয়। ইদানীং সেখানেও মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। এ খাতের জন্য আরেকটি সমস্যা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা হচ্ছে মাছের উৎপাদন খরচ এবং দাম প্রায় সমান। অর্থাৎ মাছের খাবার ও অন্যান্য উপকরণ খরচের বিপরীতে যে দামে চাষিরা মাছ বিক্রি করেন তাতে তাদের লাভ তো দূরে থাক, অনেক ক্ষেত্রে লোকসান গুনতে হচ্ছে। বিশেষ করে থাই কই, তেলাপিয়া, রুই, পাঙাশ মাছ চাষ করে চাষিরা লাভ-লোকসানের মাঝামাঝি ঝুলছেন। অন্যদিকে উৎপাদন বেশি হলে তা মজুদ করতে ধান, গম, পাট ও আলুর জন্য গুদাম ও হিমাগার আছে। কিন্তু মাছচাষিদের জন্য কোনো হিমাগার এখনো নির্মিত হয়নি।

বর্তমানে মৎস্যচাষিরাও এমন প্রজাতির মাছ চাষ করছেন, যেগুলো অতি অল্প সময়ে দ্রুত বর্ধনশীল। বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক শুধু সেসব মাছ চাষের কারণে এবং উন্মুক্ত জলাশয়ে দেশি মাছ চাষ করার ব্যাপারে অনীহার কারণেও আমরা হারিয়ে ফেলছি দেশীয় নানা মাছ। চাষের এসব মাছে কোনো স্বাদ নেই। অথচ ছোট-বড় নানা দেশি মাছের স্বাদ আজো যেন অমৃত। তাই বিলুপ্তপ্রায় দেশি মাছগুলো রক্ষা করতে খাল-বিল, পুকুর, ডোবাগুলো সুগভীর খননের মাধ্যমে মিঠা পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করতে হবে। কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কারেন্টজাল সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে হবে। মৎস্য আইনের ধারাগুলো নিশ্চিতভাবে অনুসরণ করতে হবে। সর্বোপরি জনসংখ্যা বিস্ফোরণের প্রতি লক্ষ্য রেখে মৎস্য প্রজনন বৃদ্ধি করতে হবে। প্রয়োজনে সাময়িক মৎস্য নিধন স্থগিত রাখতে গণসচেতনতা বৃদ্ধি বহাল রাখতে হবে। সরকারের উচিত, হারানো নদী পুনরুদ্ধার, নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি, নদীদূষণ রোধ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, মৎস্যচাষিদের দেশীয় মাছ চাষের ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করা। মনে রাখতে হবে, মৎস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারলে পুষ্টির অভাব পূরণ হবে এবং রফতানি বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে দেশ ও দশের প্রভূত উপকার হবে।

 

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে