ভোট দিয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন কাউকে ক্ষমতায় না আনতে দেশবাসীকে সতর্ক করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীন মনোভাবের প্রসঙ্গ টেনে একথা বলেন।
ঘূর্ণিঝড়ের পর বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘যত লোক মারা যাওয়ার কথা ছিল তত লোক মারা যায় নাই।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আবার ঐরকম কেউ যেন ক্ষমতায় না আসে যে, যত মানুষ মারা যাওয়ার কথা ছিল তত মানুষ মরে নাই বলে দায় দায়িত্বহীনতার পরিচয় কেউ যেন না দেয় ভবিষ্যতে। সেজন্যও দেশবাসীকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানাচ্ছি।
বৃহস্পতিবার (১৩ অক্টোবর) দুপুরে ‘আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস-২০২২’ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে ৫০টি মুজিব কেল্লা, ৮০টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র ও ২৫টি জেলা ত্রাণ গুদাম-কাম-দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তথ্য কেন্দ্রেরও উদ্বোধন করেন। তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন।
শেখ হাসিনা বলেন, ৯১-এর ওই দুর্যোগে শুধুমাত্র তৎকালীন বিএনপি সরকারের দায়িত্বে অবহেলার কারণে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। দেশের মানুষ যে মরছে সেদিকে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপই ছিল না। অথচ পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল প্রায় দেড় লাখ মানুষের মৃত্যু এবং ঘর-বাড়ি, গবাদি-পশু, ক্ষেতের ফসল এমনকি চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর জাহাজ এবং বিমান বাহিনীর বিমান পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আমি তখন তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আর কত মানুষ মারা গেলে আপনার মনে হবে যে তত মানুষ মারা গেছে?’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ তখন বিরোধী দলে থাকলেও সে সময় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ত্রাণ নিয়ে ছুটে যায়। পরবর্তীতে সরকারে এসে সেই ঘূর্ণিঝড় দুর্গতদের জন্য খুরুশকুল আশ্রয়ন প্রকল্প তৈরি করে তাদের পুনর্বাসন করে।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অনন্য কৃতিত্বের দাবিদার স্বেচ্ছাসেবকদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন।
৮৩ জন স্বেচছাসেবককে ১০ হাজার টাকা, সনদ এবং মেডেল প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী ৮৩ জনের মধ্যে নির্বাচিত দু’জন জয়শ্রী রানী দাস এবং মো. জসিম উদ্দিনের হাতে পদক তুলে দেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুল হাসান অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থানার ওপর একটি ভিডিও চিত্রও অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের ভৌগলিক অবস্থানের কথা চিন্তা করে উপকূলীয় অঞ্চলে বৃক্ষায়ণের মাধ্যমে যতবেশি সবুজে আচ্ছাদিত করতে পারবেন তত বেশি আমরা আমাদের দেশকে বাঁচাতে পারব।
এই বদ্বীপে আগামীর প্রজন্ম যেন সুন্দর ভাবে বসবাস করতে পারে সেজন্য তাঁর সরকার শতবর্ষ মেয়াদি ‘ডেল্টা প্ল্যান-২১০০’ প্রণয়ন করেছে উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, আরও কিছু পরিকল্পনাও আমরা গ্রহণ করেছি। যেকোনো দুর্যোগ থেকে আমাদের দেশটাকে রক্ষার ব্যাপারে আমরা সবসময়ই সচেতন।
তাঁর সরকার নদীর নব্যতা বৃদ্ধিতে নদী ড্রেজিং এবং নদী ভাঙন প্রতিরোধে এবং পুরাতন জলাধার সংস্কারের পাশাপাশি নতুন নতুন জলাধার সৃষ্টিতেও নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় সারাদেশকে দুর্যোগের মাত্রার ওপর ভিত্তি করে একে ৬টি দুর্যোগ হটস্পটে বিভক্ত করা হয়েছে। এছাড়া, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস, দুর্যোগের সাড়াদান প্রস্তুতি ও দুর্যোগ পরবর্তী পুনরুদ্ধার ব্যবস্থা উন্নয়নে ২০২১-২০২৫ সাল মেয়াদের জন্য জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। যতই দুর্যোগ আসুক আমরা সেটা মোকাবিলায় সক্ষম, আমরা সেটা প্রমাণ করেছি। এটা অব্যাহত রাখতে হবে।
সরকার প্রধান সারাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় তাঁর সরকারের ১৯৯৭ দুর্যোগ বিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলী- প্রণয়ন, ২০১০ সালে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল গঠন, ২০১২ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন প্রণয়নের কথা জানান।
তিনি বলেন, সরকার পূর্বের মুজিব কিল্লাসমূহ সংস্কারসহ নতুন করে আরও ৩৭৮টি মুজিব কিল্লা নির্মাণ করছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভ্যন্তরীণ বাস্তুহারা মানুষের দুর্দশার বিষয়গুলো আমলে নিয়ে ২০১৫ সালে একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন এবং জাতীয় রিজিলিয়েন্স পরিকল্পনা গ্রহণ করি, যা সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্ক ও এসডিজি’র সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
তিনি বলেন, আমরা ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছি। বড় ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় পূর্বাচলে একটি স্টেজিং এরিয়া নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে গত কয়েক বছরে সারাদেশে ৪২৩টি বন্যা ও ৪২০০টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র আমরা নির্মাণ করেছি। দুর্যোগের সঙ্গে সঙ্গে যাতে স্বল্প সময়ে জেলা ও প্রান্তিক পর্যায়ে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছানো যায় সে লক্ষ্যে ৬৪ জেলায় ৬৬টি ‘জেলা ত্রাণ গুদাম কাম দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তথ্য কেন্দ্র’ স্থাপন কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে রয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় একটি করে ফায়ার সার্ভিস স্টেশনও আমরা নির্মাণ করে দিচ্ছি।
‘আজ ২৫টি জেলা ত্রাণ গুদাম-কাম-দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তথ্যকেন্দ্র, ৫০টি মুজিব কিল্লা ও ৮০টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র উদ্বোধন করা হচ্ছে। আশা করছি দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস তথা জানমালের সুরক্ষায় এগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি দেশের ১৩টি উপকূলীয় জেলায় স্যাটেলাইট টেলিফোনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুর্যোগের আগাম সতর্কবার্তা ও দৈনন্দিন আবহাওয়া বার্তা জানতে মোবাইলে ‘১০৯০’ নম্বরে টোল ফ্রি সার্ভিস চালু করা হয়েছে’—উল্লেখ করেন তিনি।
দুর্যোগ প্রতিরোধে ঢাকায় গ্লোবাল অ্যাডাপটেশন সেন্টারের কার্যালয় স্থাপন এবং দুর্যোগ-পরবর্তী ত্রাণ কার্যক্রমের পরিবর্তে তাঁর সরকারের টেকসই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতি গ্রহণের কথা উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি আরও বলেন, দুর্যোগে আমরা ক্ষয়ক্ষতি কমাতে প্রশমন কর্মসূচির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছি। শাপাশি আমরা ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা- দশক ২০৩০’ এর কার্যক্রম শুরু করেছি।
প্রধানমন্ত্রী ভূমিকম্প ঝুঁকি প্রশমনে ঘরবাড়ি ও অট্টালিকা নির্মাণে অবশ্যই বিল্ডিং কোড ও আইন মানার এবং এবং অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা রাখার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। বলেন, যে কোনো মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগই মোকাবেলা করেই বাংলাদেশ তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে এবং জাতির পিতার পদাংক অনুসরণ করেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আর একদিকে করোনা তারওপর রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ এবং স্যাংশন-এসব মোকাবেলা করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হচ্ছে।