একুশে ফেব্রুয়ারির দাবি ছিল বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার। সে দাবি অর্জিত হয়েছে। শুধু অর্জিত নয়, আমরা তো বেশিই পেয়ে গেছি। আমাদের নতুন রাষ্ট্রের জন্য বাংলা অন্যতম নয়, একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। তার পরও কেন একুশে ফেব্রুয়ারি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে রয়েছে, এখনো কেন এর উদযাপনে আমাদের উৎসাহ?
তিনটি ছোট কারণ তো সহজেই চোখে পড়বে। একটি হচ্ছে মিডিয়ার ভূমিকা, যার সঙ্গে বইমেলাও জড়িত। দ্বিতীয়টি আমাদের জীবনে উৎসবের অভাব। তৃতীয়টি রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক আনুষ্ঠানিকতা। এর বাইরেও একটি বড় কারণ আছে, যেটি মুখ্য, সেটি হলো মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা এবং তার সার্বিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অতৃপ্তি। এটাকে বলা যাবে ভাষার দাবি এবং আমাদের মুক্তির স্বপ্ন, যে স্বপ্ন এখনো বাস্তবায়নের অপেক্ষায়।
প্রথম কারণগুলোর ব্যাপারে অধিক আলোচনার আবশ্যকতা নেই। সংক্ষেপেই সারা যায়। মিডিয়া এখন বিস্তৃত, সেখানে পুঁজি খাটছে এবং পুঁজি তার স্বভাব অনুযায়ী ক্ষুধার্ত, বুভুক্ষুও বলা চলে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক, বিশেষভাবে ইলেকট্রনিক মিডিয়া প্রচার করা যায় এমন বিষয় চায়। একুশে ফেব্রুয়ারি একটা ভালো বিষয়। একে মিডিয়া তার নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করে। ফেব্রুয়ারি মাসজুড়েই ভাষা আন্দোলনকে পাওয়া যায়। চ্যানেলের পর্দা এবং দৈনিকের পাতার তাতে সুবিধা হয়। মাসব্যাপী রয়েছে অমর একুশে বইমেলা। সেটি শুধু যে মিডিয়ার জন্য তা-ই নয়, পুস্তক প্রকাশকদের জন্যও অত্যন্ত উপকারী। প্রকাশকরা বিনিয়োগ করেন এবং বই বিক্রি করতে পারেন। বাণিজ্য খুব খারাপ যে হয় তা নয়, আরো ভালো হলে ভালো হতো, যা হয় তা-ও মন্দ কী, মন্দের ভালো তো ভালোই। মিডিয়ার প্রচারে বইমেলার আকর্ষণ বাড়ে। তাতে মিডিয়ার সুবিধা, প্রকাশকদেরও সুবিধা।
বাণিজ্যিক দিকের বাইরে, উদযাপনের সাংস্কৃতিক-সামাজিক দিকটাও গুরুত্বপূর্ণ। সমাজে বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। পুঁজিবাদের নানা দুষ্কর্মের ভেতর বিচ্ছিন্নতার স্থানটা মোটেই উপেক্ষণীয় নয়। মানুষের জীবনে সর্বজনীন মিলনের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে আসছে। যত বাড়ছে ভিড়, তত বাড়ছে নিঃসঙ্গতা। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান আছে; কিন্তু সেগুলো সংকীর্ণ, একুশে ফেব্রুয়ারি এমন একটি উদযাপন, যেটি একাধারে ধর্মনিরপেক্ষ ও শ্রেণি-উত্তীর্ণ। এর কারণ ভাষা ধর্ম মানে না, শ্রেণিও মানে না। অত্যন্ত কার্যকর ও ধর্ম ও শ্রেণির ওই দুই বাধা ও বিঘ্নকে সে অতিক্রম করতে চায়। মিলবার জন্য পরিসর তৈরি করে। আছে রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ। একুশে ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ উদযাপনে অংশ নেয়, প্রধানমন্ত্রী বইমেলা উদ্বোধন করেন, একুশের রাতে সরকারি ও সরকারের বাইরের নেতারা শহীদ মিনারে উপস্থিত থাকেন। বিচারকরা আসেন, আসেন বিদেশি রাষ্ট্রদূতরাও। উদযাপন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পায়। রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট ও নিয়ন্ত্রিত সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানও একুশের মর্যাদা রক্ষায় তৎপর থাকে। একুশকে স্মরণীয় করার ক্ষেত্রে এসব ঘটনা কম শক্তিশালী নয়।
সবই সত্য। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যেটি তা হলো, সব আয়োজন প্রচার ও বাণিজ্যের অন্তরালে প্রবহমান মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা এবং তাকে ঘিরে স্বপ্ন, সেই সঙ্গে এই আন্দোলনে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। আন্দোলনের শক্তি ছিল ভাষাকে মুক্ত করার স্বপ্নের ভেতর নিহিত। বলা বাহুল্য, ভাষার মুক্তি আর মানুষের মুক্তি আলাদা বিষয় নয়, ভাষার মুক্তি মানুষের মুক্তির ভেতরই নিহিত। মানুষ মুক্ত না হলে ভাষা মুক্ত হয় না।
তবে এটা তো ঠিক যে ভাষার প্রতি ভালোবাসার গভীরতা ও প্রকাশ সবার ক্ষেত্রে সমান ছিল না। থাকার উপায় ছিল না। কেননা মানুষে মানুষে পার্থক্য ছিল, ছিল ব্যবধান। এদিকে রাষ্ট্র মিত্র ছিল না বাংলা ভাষার। বিদেশি শাসকরা এসেছে, তারা তাদের ভাষাকে রাষ্ট্রের ভাষা করেছে, চেষ্টা করেছে বাংলা ভাষাকে দাবিয়ে রাখার। সবচেয়ে বেশি নিপীড়ন করেছে ইংরেজ শাসন। তারা তাঁবেদার একটি শিক্ষিত শ্রেণি তৈরি করেছে এবং দেশের মানুষকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ওই শ্রেণিকে ব্যবহার করেছে, হিন্দু-মুসলমানে বিভক্ত হতে উসকানি দিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করে রেখে চলে গেছে। এই দ্বিখণ্ডীকরণ ছিল পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলার জীবনে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।
সাতচল্লিশের দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ববঙ্গের উঠতি মধ্যবিত্ত দেখল যে স্বাধীনতার অর্থ দাঁড়িয়েছে ইংরেজদের জায়গায় অবাঙালিদের শাসন। পূর্ববঙ্গের মানুষ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, শতকরা ৫৬ জন, ১৯৪৬-এর নির্বাচনে তাদের ভোটই ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রধান শক্তি। এসব মানুষ দেখল তাদের ওপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ১৯৪৮ সালের শুরু থেকেই তাই প্রতিরোধ আন্দোলনের সূচনা। গণ-আন্দোলনে এর রূপান্তর ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারিতে। এর শক্তি ছিল ওই শতকরা ৫৬ জনই।
না, প্রথমে সবাই সাড়া দেয়নি। সম্ভব ছিল না, কেননা ৫৬ জনের বেশির ভাগই ছিল কৃষক। তাঁদের জন্য ভাষার প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ভাষার প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল উত্থান-উন্মুখ মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য। এই মধ্যবিত্ত ছিল মূলত চাকরিজীবী ও পেশাজীবী। তারা কষ্টেসৃষ্টে ইংরেজি কিছুটা রপ্ত করেছিল। মনে মনে ইংরেজিকে মেনেও নিয়েছিল। উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার আয়োজন না ঘটলে খুব একটা হৈচৈ যে করত তা-ও বোধ করি নয়। কিন্তু ঘাড়ের ওপর উর্দু চেপে বসতে যাচ্ছে টের পেয়ে তাদের ভেতর আতঙ্ক দেখা দিল। তারা দেখতে পেল ইংরেজ গেছে, এখন অবাঙালিরা আসবে, বাঙালিরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে যাবে। প্রতিবাদটা তাই ছিল স্বাভাবিক।
প্রতিবাদ অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির পরে। ছাত্র নিহত হয়েছে—এ খবরে মধ্যবিত্ত তো অবশ্যই, মেহনতি মানুষও সরব হলো। মেহনতিদের সমস্যা আর মধ্যবিত্তের সমস্যা যে হুবহু এক ছিল তা নয়। মেহনতিরা ভাষা নিয়ে তেমন ভাবেনি, কারণ বেশির ভাগ ছিল নিরক্ষর, ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ এমন অলুক্ষণে আশঙ্কাও তাদের কাছে বাস্তবিক ঠেকেনি, ভাষা কী করে কেড়ে নেয় সেটা তারা কল্পনা করতে পারেনি। তারা বিপন্ন ছিল একেবারে প্রাথমিক বাঁচার অধিকার নিয়েই। বলা হয়েছিল পাকিস্তান তাদের মুক্তি দেবে; দেখা গেল মুক্তি দেবে কী, রাষ্ট্র আরো বেশি জুলুমবাজ হয়ে উঠেছে। জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচার তো যায়ইনি, থানা-পুলিশ, দারোগা, তহশিলদার, মুসলিম লীগের পাণ্ডা টাউট-বাটপাড়দের তৎপরতা বেড়ে গেছে। মজুরি বাড়েনি, কিন্তু জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। অভাব দেখা দিয়েছে খাদ্যের। জনগণের ক্ষোভ ছিল তাই গোটা ব্যবস্থাটা নিয়েই। একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা রাষ্ট্রের লুকানো চেহারাটা তাদের কাছে উন্মোচিত করে দিয়েছিল।
মধ্যবিত্ত, যাদেরকে পেটি বুর্জোয়া বলা চলে, তাদের আতঙ্ক আর জনসাধারণের আতঙ্ক একত্র হয়ে গেল। আন্দোলনের মূল শক্তিটা ছিল এই ঐক্যের ভেতরেই। জনসাধারণ যে আন্দোলনের মিটিং-মিছিলে যোগ দিয়েছে তা নয়, কিন্তু তারা যে একে সমর্থন করছে এই বার্তাটা রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। রাষ্ট্রের জন্য ভয়টা ছিল ওইখানেই। কর্তারা তাই অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবিকে দ্রুততার সঙ্গে মেনে নিয়েছে, ১৯৫৬ সালের সংবিধানে সেটাকে তারা অন্তর্ভুক্ত করেছে। তারা প্যারিটিও দিয়েছিল। ভাবটা এই রকমের যে ৫৬-কে স্বীকার করা না গেলেও ৫০ তো দিল, পূর্ব পাকিস্তান সমান হয়ে গেল পশ্চিম পাকিস্তানের।
বাংলা ভাষার দাবি দ্রুত মেনে নেওয়ার আরো একটা কারণ ছিল। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পশ্চিম পাকিস্তানেও জেগে উঠতে পারে এই ভয়। সিন্ধি, বেলুচ, পাঠান, এমনকি পাঞ্জাবিরাও চাইতে পারে যে তাদের ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক। উর্দু তো আসলে পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো প্রদেশেরই ভাষা নয়; ভাষা সে উত্তর ভারতের। উর্দুকে আনা হয়েছিল রাষ্ট্রীয় ঐক্যকে সাংস্কৃতিকভাবে মজবুত করার জন্য; শুধু ধর্মের ওপর ভরসা করা যাচ্ছিল না, তাই ভাষাকেও আনা হলো, যেভাবে ভারত এনেছিল হিন্দিকে। বাঙালিদের দেখাদেখি অন্যান্য প্রদেশবাসীও যদি একই কাণ্ড বাধায়, তাহলে পাকিস্তান তো টিকবেই না, পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ বলে জোরজবরদস্তি করে যাকে দাঁড় করানোর চেষ্টা চালাচ্ছিল সেটির যে কোনো বাস্তবিক ভিত্তি নেই তা ধরা পড়ে যাবে এই বিবেচনাতেই বাংলায় ওই ছাড় দেওয়া, তাদের দ্রুত সম্মতি। কিন্তু তাতে বাঙালিরা শান্ত হয়নি। মধ্যবিত্ত বাঙালিকে তার বাঙালিত্ব ভুলিয়ে দেওয়ার যে চেষ্টা হয়েছিল সেটা উল্টো দিকে ঘুরে গেল, তারা বাঙালিত্বকে আঁকড়ে ধরল দুই কারণে—প্রথমত, বাঙালিত্ব ভুলিয়ে দেওয়ার অর্থ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল অবাঙালিদের গোলাম করে রাখা। সেটা আপাতত স্থগিত হলেও অভিসন্ধিটা যে রয়ে গেল বাঙালি সেটা জেনে ফেলল। দ্বিতীয়ত, ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ জিনিসটা যে ভুয়া ছিল সেই সত্যের উন্মোচন। জাতি গঠনে ধর্মের তুলনায় ভাষার কার্যকারিতা যে অনেক বেশি সেটা জানা হয়ে গেছে। শাক আর পারেনি মাছকে ঢেকে রাখতে।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মূল জায়গাটাই ছিল ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কাছে চলে যাওয়া। অর্থাৎ স্বাভাবিক হওয়া। ভাষা আন্দোলন শুধু যে রাষ্ট্রের শাসকদের বিরুদ্ধে ছিল তা নয়, ছিল পাকিস্তানি রাষ্ট্রের ধারণার বিরুদ্ধেই। রাষ্ট্রদ্রোহী এই অভ্যুত্থান যে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা পেয়ে থেমে যাবে এমন সম্ভাবনা ছিল না। থেমে না যাওয়াটাই সত্য হয়েছে। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ বের হয়ে এসেছে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাভূত করে।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়