খালেদা জিয়া আবার গণমাধ্যমের শিরোনামে এসেছেন। এবার তাঁকে ঘিরে প্রশ্ন, তিনি রাজনীতি করতে পারেন কি না? এ ব্যাপারে বিভিন্ন জন ভিন্ন ভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন।
খালেদা জিয়াকে দুটি মামলায় দণ্ড দেওয়া হয়েছে। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিচারিক আদালত তাঁকে সাত বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। সেই রায়ের বিরুদ্ধে তাঁর আপিল এখন মহামান্য হাইকোর্টে বিচারাধীন। আর জিয়া অরফানেজ মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করলে মহামান্য হাইকোর্ট তাঁর সাজা বাড়িয়ে তাঁকে ১০ বছরের দণ্ডাদেশ দিয়েছেন। জিয়া চ্যারিটেবল মামলাটির আপিল এখন হাইকোর্টে বিচারাধীন থাকায় হাইকোর্টের সিদ্ধান্তক্রমেই সেটি নির্ধারিত হবে। অন্যদিকে অরফানেজ মামলাটি মহামান্য হাইকোর্টের রায় বিধায় সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করতে হলে আপিল বিভাগে আপিল করতে হবে। কিন্তু সেটি সহজ নয়। হাইকোর্টের যে তিন ধরনের রায়ের বিরুদ্ধে অধিকারবলে আপিল বিভাগে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপিল করা যায়, খালেদা জিয়ার মামলার রায় সেই তিন ধরনের মধ্যে পড়ে না বিধায় আপিল করতে হলে প্রথমে আপিল বিভাগ থেকে আপিলের অনুমতি (লিভ টু আপিল) নিতে হবে। এই অনুমতি পাওয়ার জন্য আপিল বিভাগে শুনানি করতে হবে। আর আপিল বিভাগ যদি মনে করেন অনুমতি দেওয়া উচিত, শুধু তবেই খালেদা আপিল বিভাগে আপিল করতে পারবেন, অন্যথায় হাইকোর্টের রায়ই তাঁর জন্য চূড়ান্ত হয়ে থাকবে। সেই অর্থে এই মুহূর্তে আপিল বিভাগে খালেদা জিয়ার কোনো আপিল বিচারাধীন নেই। খালেদা জিয়া বেশ কয়েক বছর আগে আপিল বিভাগে একটি অনুমতির দরখাস্ত করে রেখেছেন, অথচ অজানা কারণে সেই দরখাস্তের শুনানি তিনি করছেন না। এর সঙ্গে জামিনের প্রশ্নও জড়িত। অরফানেজ মামলায় জামিনের দরখাস্ত শুধু আপিল বিভাগই শুনতে পারেন, অন্য কোনো আদালত নয়। তা ছাড়া আপিল বিভাগ খালেদাকে আপিলের অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত আপিল বিভাগও জামিনের দরখাস্ত শুনতে পারবেন না। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় অবশ্য হাইকোর্ট বা আপিল বিভাগ (অন্য কোনো আদালত নয়) এখনই খালেদার জামিনের আবেদন শুনতে পারেন। কেননা হাইকোর্টে তাঁর আপিল বিচারাধীন। কিন্তু জিয়া চ্যারিটেবল মামলায় জামিন পেলেও তিনি বের হতে পারবেন না অরফানেজ মামলায় জামিন না পেলে, আর সেটির জন্য দরখাস্ত করতে হলে তাঁকে প্রথমে আপিল বিভাগে শুনানি করে আপিল করার অনুমতি নিতে হবে, যে শুনানি তিনি বহু বছর ধরেই করছেন না। এ বিষয়ে অনেকে না জেনে, আবার কেউ কেউ আইনি অবস্থা জেনেও শুধু জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য অনেক উদ্ভট কথা বলে থাকে। তাই বিভ্রান্তি রোধকল্পে আবার বলতে চাই, এই মুহূর্তে জিয়া অরফানেজ মামলায় খালেদা জিয়াকে জামিন দেওয়া তো দূরের কথা, জামিনের আবেদন শোনারও ক্ষমতা আপিল বিভাগের নেই। কারণ আপিল বিভাগে সেই রায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপিল নেই। আর অন্য কোনো আদালতের তো সেই ক্ষমতার প্রশ্নই অবান্তর।
সরকারের বিশেষ বদান্যতায় খালেদা এখন বন্দিমুক্ত জীবন কাটাচ্ছেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় খালেদা জিয়াকে সাময়িকভাবে মুক্তজীবন কাটানোর যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সেই ব্যাপারটি একান্তই সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপার। ৪০১ ধারার ব্যাপারে কারো কোনো অধিকার থাকে না। খালেদা জিয়া এ অবস্থায় রাজনীতি করতে পারেন কি না, তা নির্ভর করছে রাজনীতির ধরনের ওপর। নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় তিনি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না সংবিধান আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে। এমনকি মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাঁর সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে ক্ষমা করে দিলেও তাই হবে। কেননা মহামান্য রাষ্ট্রপতি সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ক্ষমা করে জেল থেকে মুক্ত করতে পারেন, কিন্তু তাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সাজার রেকর্ড মুছে যায় না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে রাজনীতি নির্বাচনকেন্দ্রিক হওয়ায় সেই ধরনের রাজনীতি তিনি করতে পারেন না। কিন্তু কোনো প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে নামার বা কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে কোনো বাধা সংবিধান বা কোনো আইন আরোপ করেনি। রাজনৈতিক ভাষণ বা কোনো প্রার্থীর পক্ষে কথা একজন কয়েদি জেলখানার অভ্যন্তরে থেকেও বলতে পারেন, অবশ্য সেগুলো বাইরে প্রকাশের বিরুদ্ধে জেল কোডে নিয়ন্ত্রণমূলক বিধান রয়েছে। খালেদা জিয়া যে রাজনীতি করছেন না, তা কিন্তু নয়। তাঁর বাসভবনে প্রায়ই তাঁর নেতৃত্বে বিএনপি নেতাদের বৈঠক হচ্ছে, যেসব বৈঠকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও হচ্ছে। এসবে কেউ কখনো বাধা দেয়নি। কিন্তু রাস্তায় নেমে ভাষণ দেওয়া বা কোনো প্রার্থীর পক্ষে কথা বলার মতো শারীরিক অবস্থা নিশ্চয়ই তাঁর নেই বলেই তিনি রাস্তায় নামছেন না। বাসায় বসে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন এবং সিদ্ধান্তগুলো গণমাধ্যমে প্রচার-প্রকাশিতও হয়ে থাকে।
তাঁর রাজনীতির বড় বাধা হচ্ছে বাস্তবতা। আমরা টেলিভিশনে যা দেখতে পাই তা হলো শারীরিকভাবে তিনি এখন আর রাস্তায় নেমে রাজনীতি করার মতো অবস্থায় নেই। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তাঁর আর কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই এবং হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই। রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে তিনি অতীত হয়ে গেছেন এবং সেটি তিনি নিজে এবং তাঁর দলের নেতারা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারছেন। তাঁরা কিন্তু কয়েক বছর ধরেই বলে বেড়াচ্ছেন খালেদাকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য না পাঠালে তিনি আর বাঁচবেন না। এ কথাগুলোর ভিত্তি যে মিথ্যা, খালেদা জিয়া বেঁচে থেকেই তা প্রমাণ করেছেন। এ ব্যাপারে কবিগুরুর ‘জীবিত ও মৃত’ উপন্যাসে লিখিত সেই কথাটিই মনে করিয়ে দেয় ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই’। তিনি বেঁচে থেকে এদের সবাইকে মিথ্যাবাদী বলে প্রমাণ করেছেন, কিন্তু রাজনীতি করার মতো দৈহিক সামর্থ্য এখন তাঁর নেই। আর নানা কারণে জনগণও তাঁকে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। তাঁর অবস্থা এখন আসলেই ইতিহাসের পাতায় খোঁজার মতো। আর একটি কথা হলো, ৪০১ ধারায় কাউকে সাময়িক মুক্তি দেওয়ার পর সরকার তার ঐচ্ছিক ক্ষমতাবলে কোনো দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে প্রদান করা সেই বিশেষ সুবিধা যেকোনো সময়ই তুলে নিতে পারে। কোনো রিট মামলা করে সরকারের এহেন সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করার কোনো সুযোগ থাকে না। তাই খালেদা জিয়া যদি রাজনৈতিক কারণে রাস্তায় নেমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার সক্ষমতা অর্জন করেনও, তাহলে সরকার তাঁকে আবার কারান্তরালে পাঠাতে পারবে। সে কথা মনে করেই তিনি রাস্তায় নামেননি বলে কেউ কেউ মনে করছে। কিন্তু পারিপার্শ্বিক সব পরিস্থিতি বিবেচনায় এটি মনে করাই অধিক যুক্তিসংগত যে খালেদা জিয়া সেই দৈহিক সক্ষমতা ধরে রাখতে পারেননি। অত বয়সী না হলেও তাঁর অবস্থা অনেকটাই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ ছবির সেই বৃদ্ধার মতো বলেই মনে হচ্ছে।
খালেদা জিয়া যেমন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছেন, তেমনি তিনি রাজনীতি করতে পারেন কি না, সেই প্রশ্নও এখন অপ্রাসঙ্গিক।
লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি