সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৩তম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস আজ। ১৯২০ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। শেখ মুজিব শুধু একটি নাম নয়, একটি আদর্শ, একটি চেতনা, একটি ইতিহাস, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কারিগর। যার নেতৃত্বে আমরা পেয়েছি বাংলাদেশ নামক দেশটি।
আজ দেশ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার কারণে। যার সঠিক নির্দেশনায় দেশ এগিয়ে চলছে। শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও রাজনীতি লিখলে সারাদিন বা সারা মাসে শেষ হবে না। জাতির জনক বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আজকের দিনে তাঁর প্রতি জানাচ্ছি বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁর আত্নার মাগফিরাত কামনা করছি।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক শব্দ। একে ওপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি অন্যটি ছাড়া কল্পনা করা যায় না। বঙ্গবন্ধু নামে চেতনা, আমাদের এই চেতনা ধারণ এবং লালন করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে তাঁর চেতনা সম্পর্কে জানাতে হবে। সেজন্য সরকার এবং আমাদেরকে নানামুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। তাঁকে নিয়ে গবেষণা করতে হবে যাতে নতুন নতুন তথ্য মানুষ তাঁর সম্পর্কে জানতে পারে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা পর্যন্ত তাঁর ত্যাগের কথা বলে শেষ করা যাবে না। প্রতিটি আন্দোলনে জীবনকে বাজি রেখে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যার কারণে আজ আমরা স্বাধীন এবং আমরা আজ আমাদের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারছি। যিনি জন্মেছিলেন বলেই,আজ আমরা একটি স্বাধীন ভূখণ্ড এবং একটি জাতীয় পতাকা পেয়েছি।
পতাকার দিকে থাকালে তাঁর কথা মনে পড়ে যায়। আমাদের সন্তানকে জাতীয় পতাকা এবং ৭ মার্চের জাতির জনকের ভাষণের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। এভাবে আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানানো আমাদের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব।
এই দায়িত্ব পালনের মধ্যে দিয়ে আমরা জাতির জনকের আদর্শ এবং চেতনা চর্চা করবো। অনেকেই মুখে বলে, কিন্তু তাঁদের কাজে কর্মে বঙ্গবন্ধুর চেতনার বাস্তব প্রতিফেলন দেখি না। তখন কষ্ট হয়। বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত আদর্শ মনে এবং হৃদয়ে ধারণ করে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাহলেই বঙ্গবন্ধুর আত্না শান্তি পাবে বলে বিশ্বাস করি।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন নির্যাতিত মানুষের নেতা, যা তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে,যেমন ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু আলজেরিয়ার রাজধানীতে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেখানে তিনি বলেছিলেন পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত। এক হল শোষকের আর অন্য হল শোষিতের পক্ষ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ওই ভাষণে বলেন আমি শোষিতের পক্ষে। ওই দিন ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়ের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। কি এক সৌভাগ্য জাতি আমরা তাঁর মত নেতা পেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি ১৯৭৫ সালে ঘাতকের বুলেটে যদি নিহত না হতো আজ দেশ আরও উন্নত এবং শক্ত অবস্থানে থাকত। কারণ তাঁর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক চিন্তা ছিল সুদূরপ্রসারী।
যা তিনি ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পর যখন ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি দেশে এসে রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া ভাষণটি তাঁরই প্রমাণ। কারণ ওই ভাষণে তিনি বাংলাদেশের ভবিষ্যত সমৃদ্ধি এবং দেশ পুনর্গঠনের রূপরেখা দিয়েছিলেন। যা ছিল খুবই প্রশংসনীয়। তিনি খুব অল্প সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন করতে পেরেছিলেন। তিনি সব সময় জাতি ও দেশ গঠন এবং দেশের মানুষকে নিয়ে চিন্তা করতেন। দেশের মানুষকে এবং শিশুদেরকে খুবই ভালোবাসতেন।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন উদার চিন্তা-চেতনার মানুষ। জীবন বাজি রেখে পরিবার-পরিজনের স্বার্থ ত্যাগ করে জনগণের কথা বলতেন এবং নিঃস্বার্থ রাজনীতির উদাহরণ সৃষ্টি করে গিয়েছেন। যা এক বিরল নজির সৃষ্টি করে গেলেন এই ক্ষণজন্মা মহামানব। এমনকি তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রাপ্য সম্মান বা শ্রদ্ধা দিতে ভুল করতেন না। যা ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বুঝতে পারা যায়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমাজে তিনি ছিলেন এক অনন্য উদাহরণ । যার জন্য তিনি সকল মানুষের নিকট শ্রদ্ধা পেয়ে যাচ্ছেন এবং পাবেন।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। যা ১৯৫২ এবং ১৯৫৮ সাল থেকে শুরু হয়। যেমন ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব খানের স্বৈরশাসন জারি হওয়ার পর মাওলানা ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধুর মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠে এবং স্বৈরশাসনের বিপক্ষে বিভিন্নভাবে আন্দোলন এবং সংগ্রাম পরিচালনা করেন। এভাবে তিনি হয়ে উঠেন জনগণের অবিসংবাদিত নেতা । ১৯৪৮,১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯ এবং ১৯৭১ সালের বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা লিখে বা বলে সমাপ্ত করা যাবে না।
প্রত্যেকটি আন্দোলনে তাঁর ছিল স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং কঠোর ভূমিকা ছিল, যার কারণে তিনি হয়েছেন সাধারণ মানুষের নেতা। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি সিদ্ধান্ত ছিল সুপরিকল্পিত এবং তিনি বিশ্বাস করতেন প্রগতি মানে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলা এবং সেভাবে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া।
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ, ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান এবং ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তাঁর দেওয়া ভাষণ প্রতিটি ভাষণ ছিল যুগান্তকারী এবং সময়োপযোগী। প্রতিটি ভাষণ মনে রাখতে হয় কারণ তাঁর ভাষণে নেতৃত্ব এবং দেশকে ভালোবাসার সঠিক নিদর্শন পরিলক্ষিত হয়েছে। যার কারণে তিনি অন্যান্য জাতীয় নেতা থেকে ভিন্ন এবং আলাদা।
১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে একজন সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আজ আপনার ৫২তম জন্মদিন। এই জন্মদিনে আপনার ইচ্ছে কি? উত্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, জনগণের সার্বিক মুক্তি। একটা মানুষ কত বড় মনের মানুষ হলে একথা বলতে পারেন। তাই তিনি কোনোদিন ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করেননি, করেছেন জনগণের কল্যাণের জন্য। অতি সাধারণ জীবন ছিল তাঁর। রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার পরও সরকারি বাসভবনে থাকতেন না।
ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে আমৃত্যু থেকে গিয়েছেন। এটাই জনকল্যাণের রাজনীতি, ভোগের রাজনীতি নয়। এখান থেকেই আমাদের বর্তমান রাজনীতিবিদের অনেক কিছু শেখার সুযোগ রয়েছে। এখনতো রাজনীতি করা হয় কীভাবে রাতারাতি বড়লোক হওয়া যায় সেজন্য। একারণেই সাধারণ মানুষ বর্তমান রাজনীতিকে পছন্দ করে না।
তাই অনুরোধ করবো বঙ্গবন্ধুর মত রাজনীতি করেন এবং তাঁর প্রকৃত আদর্শ বুকে লালন করে সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করেন। দেখবেন জনগণই আপনাকে বারবার নেতা বানাবেন। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা তাঁরই আদর্শ ধারণ করে দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং দেশকে বিশ্বের মানুষের নিকট ইতিবাচক ভাবে তুলে ধরছেন। আমরা বঙ্গবন্ধুর চেতনা ধারণ করে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে ভূমিকা রাখি।
বঙ্গবন্ধু আজীবন মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য কাজ করছেন। বারবার কারাবরণ করেছেন। মামলা-হামলা, জেল-জুলুম এবং অত্যাচার -নির্যাতন কোনোকিছুকে ভয় করতেন না। এসবকে উপেক্ষা করেও জনগণের জন্য নিবেদিত ছিলেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন সর্বদা। অন্যায়ের সঙ্গে তিনি কখনও আপস করেননি এবং মাথা নত করেননি কোন মুহূর্তে ।
ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু মানুষের মুক্তি এবং অধিকারের কথা বলতেন। তাঁকে কোনো পদপদবি এবং লোভ লালসা আকৃষ্ট করতে পারেনি। যা তিনি তাঁর বিভিন্ন ভাষণে এবং কাজেকর্মে প্রমাণ রেখে গিয়েছেন। আমরা যারা আদর্শ ধারণ করি এবং চর্চা করি, তাঁদেরকে বলবো আমরা যেন জনগণ এবং সাধারণ মানুষের দুঃখকষ্ট নিয়ে ভাবি এবং তাদের পাশে দাঁড়াই। তাঁদের বিপদে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় এটাই হোক আজকের প্রত্যাশা। আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে তাঁকে গভীরভাবে স্মরণ করি।
লেখক: সাবেক সভাপতি-শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।