২৬ মার্চ বাঙালির ইতিহাসে রক্তের আখরে লেখা একটি চিরঅমলিন তারিখ। এটি অকস্মাৎ কোনো দিবস বা ঘটনা নয়। বাঙালির মনের ভেতর হাজার বছরের সযত্নে লালিত স্বপ্নের, অর্থাৎ স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার বাঙ্ময় রূপান্তর ঘটে এই দিনে। অথচ আমাদের এই পথচলালগ্নে বিশ্বমোড়লদের কত শঙ্কা, কত সমালোচনা ছিল। ঘুরে দাঁড়ানোর কথা বলবে তো দূরের কথা আমাদের অস্তিত্বই নাকি বিপন্নহবে- এমন কথাও তাঁরা বলেছিল। সেদিন যারা এদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় ছিল তাঁরাও এখন স্তম্ভিত, এদেশ এখন নতুন পৃথিবীর জন্য অন্যন্য দৃষ্টান্ত। দুনিয়ার নিপীড়িত, শোষিত আর নির্যাতিত মানুষের মনে বাংলাদেশের এই উত্থান আশার আলোর মতো জ্বলছে।
১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশবাসী বঙ্গবন্ধুকে ভোট দিয়ে নিজেদের শাসন করার, তাঁদের পক্ষে কথা বলার ক্ষমতা অর্পণ করেছিলেন। ১৯৭১ সনের ১০এপিল গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ -এ তা এইভাবে বিধৃত হয়েছে- ‘এবং যেহেতু এরূপ প্রতারণাপূর্ণ ব্যবহারের বাস্তব অবস্থা ও পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের ন্যায়সঙ্গত দাবী পূরণের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ঢাকায় স্বাধীনতার ঘোষণা দান করেন এবং বাংলাদেশের মর্যাদা ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। অতঃপর এই ঘোষণার অনুবৃত্তিক্রমে ঘোষণা করা হয় ”এবং যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাহাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী উদ্দীপনার মাধ্যমে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের উপর তাহাদের কার্যকর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছে,
সেহেতু আমরা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণ কর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে, নিজেদের সমন্বয়ে যথাযথভাবে একটি গণ-পরিষদ গঠন করিলাম, এবং পারষ্পরিক আলোচনা করিয়া, এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে,
সার্বভৌম প্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম এবং তদ্বারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ইতিপূর্বে ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করিলাম, এবং……।’
বস্তুত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার বৈধতা ছিল জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনের দৃষ্টিতে এবং এটিকে আন্তর্জাতিক মহলে আইনি বৈধতা দেওয়ার জন্যই গণ-পরিষদ গঠন ও গণ-পরিষদ কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘোষণাকে অনুমোদন ও গ্রহণ করা আবশ্যক ছিল। এবং ১০এপ্রিল ১৯৭১ এর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ গ্রহণ ও সরকার গঠন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে আইনি বৈধতা দেওয়া ও চলমান যুদ্ধকে একটি কমান্ড স্ট্রাকচারে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে একক ভূমিকা পালন করে। এই সব কর্মকাণ্ড সংগঠিত হওয়ার পূর্বে ২৬শে মার্চ সকালে চট্টগাম বেতার কেন্দ্র থেকে (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বলে পরিচিতি দিয়ে) চট্টগাম আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব এম.এ. হানান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা নিজ কণ্ঠে প্রচার করেন এবং ২৭ মার্চ চট্টগ্রামে স্বাধীনতাকামী মুক্তিসংগ্রামীদের কাতারে শামিল হয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমানও একই কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। একই সময়ে কুষ্টিয়া-চুয়াডাঙ্গা সীমান্তে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, ময়মনসিংহে মেজর এম.শফিউল্লাহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মেজর খালেদ মোশাররফ, চট্টগ্রামে সীমান্তে কর্মরত মেজর রফিক প্রমুখ সেনা কর্মকর্তাগণ মুক্তিযুদ্ধে শামিল হন। সারাদেশে আওয়ামীলীগের স্বাধীনতার ঘোষণার আলোকে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। প্রত্যেক জেলার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস অধ্যয়ন করলেই আমাদের বক্তব্যের যথার্থতা বেরিয়ে আসবে।
এই ১০এপ্রিল পৌঁছার আগে ৪ এপ্রিল ১৯৭১ এ ব্রাহ্মণবাড়িয়া হবিগঞ্জের সীমান্ত প্রান্তে অবস্থিত তেলিয়াপাড়া চা বাগানে জাতীয় পরিষদ সদস্যগণ কর্ণেল এম.এ.জি. ওসমানী (অব.) ও লে. কর্ণেল এম.এ. রব (অব.) এর নেতৃত্বে যুদ্ধরত পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডারদের একটি সভা অনুষি্ঠত হয়। উক্ত সভায় জিয়া, শফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ, কাজী নুরুজ্জামান, মোমিন চৌধুরী প্রমুখ সামরিক কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন। এখানে পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধকে একক কমাণ্ডে নিয়ে আসতে কর্ণেল ওসমানী ও কর্ণেল রব-কে প্রধান ও উপ-প্রধান করে মুক্তিফৌজ গঠন করা হয়। অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আগরতলা ও কলকাতায় সমবেত হয়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করেন। উভয় অংশের রাজনৈতিক নেতৃত্বই সরকার গঠন ও যুদ্ধ পরিচালনায় একক কমাণ্ড গঠনে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং সেনাবাহিনীর লোকদেরকে সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে সমন্বয় সাধন করেন। মার্চব্যাপী ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনাসমূহ যা
২৬ মার্চ চূড়ান্তপরিণতিতে পৌঁছে এবং ফলশ্রুতিতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদান করেন। ইতিহাসের বিচারে এর চেয়ে সত্য কিছু নেই। এখানেই শেষ নয়। The Declaration of Independence বা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে আমাদের সংবিধানের অংশ করে নেওয়ায় (অনচ্ছেদ ১৫০) ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণার কথা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হয়। সংবিধানের এত এত সংশোধনী সত্তেও অনচ্ছেদ ১৫০ এর কোনো সংশোধনী না হওয়ায় বিষয়টি সাংবিধানিকভাবে নিষ্পত্তিকৃত। আর সংবিধান যেহেতু দেশের সর্বোচ্চ আইন সেহেতু আইনসঙ্গতভাবে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। কিন্তু ইতিহাস তো শুধু আইন বা সংবিধান মেনে এগোয় না। ইতিহাসের নিজস্ব গতিময়তা আছে, যা আইন বা সংবিধানের চেয়েও শক্তিশালী। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য। আর ইতিহাসের সত্য হচ্ছে যে ২৬ মার্চ পৌঁছতে বাঙালি যে পথ পরিক্রমা করেছে তাও বিবেচনায় রাখতে হবে। ১৯৭০ এর নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে ১২ নভেম্বর দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে প্রায় ১০ লাখ লোক নিহত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু এই ঘূর্ণিবিধ্বস্ত এলাকা সফর শেষে ২৬ নভেম্বর তদানিন্তন হোটেল শাহবাগে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছিলেন- ”ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে নিহত ১০ লাখ লোক আমাদের ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ করে গেছে, তা সম্পাদনের জন্য, আমরা যাতে নিজেদের ভাগ্যনিয়ন্তা হতে পারি তার জন্য প্রয়োজনবোধে আরো ১০ লাখ বাঙালি প্রাণ দেবে।
১৯৬৯ সনের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃ্ত্যু বার্ষিকীতে এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন- ”আজ থেকে এ দেশের নাম বাংলাদেশ। ১৯৭১ এর ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারের পাদদেশে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘বাঙালিদের স্বাধীকার আদায়ের আন্দোলনে আরো রক্তদানের জন্য ঘরে ঘরে প্রস্তুত থাকুন। …আমিও আজ শহীদ বেদী থেকে বাংলার জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছি, প্রস্তুত হও, দরকার হয় রক্ত দেব। …আমরা স্বাধীকার চাই। …আমি জানি না আবার কবে আপনাদের সামনে দাঁড়াতে পারবো। তাই আজ আমি আপনাদের এবং সারা বাংলার মানুষকে ডেকে বলছি পরম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হন। ”২৮ ফেব্রুয়ারি’৭১ এ ঢাকা শিল্প ও বণিক সমিতির সংবর্ধনা সভায় তিনি ঘোষণা করেন- ”জয় বাংলা কেবলমাত্র রাজনৈতিক শ্লোগান নয়। এটা বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক স্বাধিকারের প্রতীক।
সারা মার্চ জুড়ে অগণিত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে তিনি আন্দোলন ও সংগ্রামের কৌশল তুলে ধরেন। এদিন বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের উপস্থিতিতে এই মহান নেতা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশা আল্লাহ।’
তিনি বললেন – ‘আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোটকাচারী, আদালত- ফইজদারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সেইজন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিস গুলো আছে সে গুলোর হরতাল কাল থেকে……, রিকসা, ঘোড়াগাড়ি চলবে, রেল চলবে,লঞ্চ চলবে, শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গর্ভনমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোনো কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন।’ তিনি বললেন – ’এরপরে যদি বেতন না দেওয়া হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর কাছে আমার অনুরোধ রইল, ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল।’
৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করে দিক নির্দেশনা দিলেন সংগ্রামশীল মানষের করণীয় সম্পর্কে। তিনি বললেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ তিনি আরও বললেন (এবং আসন্ন যুদ্ধে তাঁর অনুপস্থিতির দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বললেন)- ’আমি যদি হুকম দেবার নাও পারি এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো (অর্থাৎ সেনানিবাসসমূহের সরবরাহ লাইন বন্ধ করে দিতে হবে)। দৃপ্ত কণ্ঠে তিনি প্রত্যয় দৃঢ় ঘোষণা দিলেন- ‘…………আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। মরতে যখন শিখেছি, তখন কেউ আমাদের মারতে পারবে না।’
একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ কৌশল তিনি সেদিন জাতির সামনে উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি, বঙ্গবন্ধু, গণতন্ত্রের জন্য গণতান্ত্রিক পন্থায় অভ্যস্থ এক সংগ্রামী নেতা, সশস্ত্র যুদ্ধ সম্পর্কে যার অভিজ্ঞতা বই পুস্তক পাঠের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং যিনি বিশ্বাসে ও কর্মপন্থায় একজন গণতান্ত্রিক মানুষ, হঠাৎ করে এই বাস্তবতার সম্মুখীন হলেন যে, দেশকে শত্রু মুক্ত করতে হলে সশস্ত্রতার কোন বিকল্প নেই। তাই তিনি গেরিলা যুদ্ধেরও রূপরেখা দিলেন তাঁর বক্তব্যে। তিনি ঘোষণা দিলেন- ‘………..আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার দেশের মুক্তি না হয়, খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়া হল, কেউ দেবে না।’ তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘কিন্তু পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। যদি এই দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝে শোনে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল। এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।
আর এ অসহযোগ চলতে থাকাকালে আন্দোলনকে একটি সুনির্দিষ্ট গতিপথে পরিচালনা করতে এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বিকল্প শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের একটি প্যারালাল সরকার গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তাজউদ্দিন আহমদ নির্দেশাবলি জারি করতে থাকেন। আওয়ামীলীগের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর হয়ে তাজউদ্দিন সর্বমোট পয়ত্রিশটি নির্দেশ জারি করেছিলেন। এতে একটি প্যারালাল সরকার দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। যার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল আওয়ামীলীগ (নির্বাচনী রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে) স্বাধীনতা ঘোষণার নৈতিক ও আইনগত অধিকার অর্জন করেছিলেন। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার একমাত্র বৈধ কর্তৃত্ব এভাবে তাঁর ওপর অর্পিত হয়েছিল। এবং তিনি জনগণ অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছিলেন।
আজ স্বাধীনতার বায়ান্ন বছরে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। দুই বছর পূর্বে উদযাপন করছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। একটি রাষ্ট্রের জীবন পরিক্রমায় এই অর্ধশত বছর বড় কোনো অতিক্রমন নয় । কিন্তু বায়ান্ন বছরে এই জাতি রাষ্ট্রের ভিত্তি কতটা মজবুত হয়েছে তা একবার বিচার করে দেখার সুযোগ তো রয়েছে। যে আদর্শিক অবস্থান নিয়ে এই দেশের জন্য লড়েছেন মানুষ, আত্মাহুতি দিয়েছেন ত্রিশ লক্ষ বীর বাঙালি আর সম্ভ্রমহারা হয়েছেন লাখো নারী, ৫২ বছরে সেটির অবস্থা কি তাতো একবার ভেবে দেখা দরকার। সরকার আসে সরকার যায় রাষ্ট্র তো স্থায়ী অস্তিত্ব। তো রাষ্ট্রের অর্জন কী। বায়ান্ন বছরে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। এই এগিয়ে যাওয়া হচ্ছে বৈষয়িক। আর্থ-সামাজিক দিক থেকে, অবকাঠামো উন্নয়নের দিক থেকে আমরা অভাবনীয় ও অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করেছি ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯-২০২৩ পর্যন্ত সময়ে। মাঝের ২৮ বছরে বাংলাদেশের উন্নয়নের গতি ধারায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। বিশ্বাসঘাতক মোশতাক ও তাদের দোসররা মিলে রাষ্ট্র পিতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা ও তাঁর সরকার উৎখাত করে বাংলাদেশের উল্টো যাত্রার সূচনা করে। সামরিক স্বৈরশাসক জিয়া, এরশাদ এবং তাদের প্রতিক্রিয়ার দোসর সাত্তার-খালেদা জিয়া-ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিনের সরকার মোশতাকের পথ ধরে বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাই শুধু নয়, আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ভাবাদর্শ ও বঙ্গবন্ধু মুজিবের আদর্শের উল্টো পথে দেশকে নিয়ে গিয়েছিল। সেই কারণে আমরা বৈষয়িক উন্নয়নে প্রায় পঞ্চাশ বছর আর মতাদর্শগতভাবে প্রায় শত বছর পিছিয়ে গিয়েছি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সরকার গঠনে এবং ধর্মনিরপেক্ষ ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনে আমাদের অর্জন ক্রমশ পশ্চাৎমুখী। রাজনীতি এখন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিপরীত পথে হাঁটছে। আজ আমরা স্বাধীনতার ৫৩ বছরে পদার্পণ করেছি। এ সময়ে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন কতটুকু হয়েছে তা ভেবে দেখতে হবে। বৈষম্যহীন সমাজের আকাঙ্ক্ষায় রচিত বাংলাদেশে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়া এবং লুটেরাদের পক্ষে অর্থনীতিকে দাঁড় করানো কতটা যুক্তিযুক্ত হয়েছে ভেবে দেখা দরকার। লুটেরাতন্ত্র আর বৈষম্যহীন অর্থনীতি কি সমার্থক?
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর মুজিবের সংগ্রাম একই সুতোয় গাঁথা। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থা, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক সমাজ রাজনীতি, বৈষম্যহীন সুষম বন্টনের অর্থনীতি সব মিলিয়ে ইতিবাচকতার জাতীয়তাবাদী বাঙালি-বাংলাদেশ গড়ে তুলতে এই পঞ্চাশ বছরে আমরা কতটা সক্ষম হয়েছি? নাসিরনগর, গাইবান্ধা, সুনামগঞ্জের শাল্লা, কক্সবাজারের রামু, ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলন, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত প্রশ্নে সীমাহীন ধৃষ্টতা নিয়ে আমরা কতটা এগুতে পেরেছি? ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা কওমী হাফেজী মাদ্রাসা, মানহীন কিন্ডারগার্টেন শিক্ষাক্ষেত্রে যে অরাজকতার জন্ম দিয়েছে, তা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের অগ্রযাত্রাকে ও স্থায়ী উন্নয়নের পথযাত্রাকে ব্যহত করতে বাধ্য।
আমরা জানি সরকারের কর্তাব্যক্তিদের নজরে আসার জন্য, নেতৃত্বকে পরিতুষ্ট করতে নানাভাবে রাষ্ট্র ও সরকারের সাফল্য গাঁথা গাওয়া হবে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশে উত্তরণ নিঃসন্দেহে বড় ব্যাপার। কিন্তু তার চেয়েও বড় ব্যাপার একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা, যা এই উন্নয়নকে ধারণ করে অগ্রযাত্রাকে সুগম করতে পারে। সে লক্ষ্যে আমাদের কাজ কী পরিদৃষ্ট হয়? রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আর অর্থনীতির পরিচালনায় যে পথ অনুসরণ করা হচ্ছে তা কী আদৌ আমাদেরকে দীর্ঘস্থায়ী অগ্রযাত্রার স্বস্তি দেবে? স্বাধীনতার ৫২ বছরে দাঁড়িয়ে আজ এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজা দেশপ্রেমিক সকল নাগরিকের দায়িত্ব। কতিপয় চাটুকার আর তল্পিবাহকের মধুমিশ্রিত কথায় বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ নেই। লুটেরাতন্ত্রের অবসান একান্তভাবেই কাম্য। নির্বাচন ব্যবস্থাকে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে দাঁড় করানো আবশ্যক। আমলাতান্ত্রিকতা নয়, জনগণের অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করা দরকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং জন প্রশাসনে। সর্বোপরি আইনের শাসন ও জবাবদিহিতামূলক জনপ্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র নিশ্চিত করা প্রয়োজন। স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও সুশাসনের পক্ষের বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
স্বাধীনতার ৫২ বছর উদযাপনের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এবং পঁচাত্তর পরবর্তী একজন প্রতিরোধ সংগ্রামী হিসেবে প্রশ্নগুলো এসে ভীর জমায় মনের গহীনে। যখন দেখি বাংলাভাষা বিদ্বেষীরা রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ নিচ্ছে, চিহ্নিত লুটেরারা অর্থনীতির নেপথ্যের চালক, মুক্তিযুদ্ধ তথাকথিত নিরপেক্ষবাদীরা (এদের অনেকে ১৬ ডিসেম্বর বাহিনীও হয়েছে) বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে, মুজিব হত্যায় যারা সুযোগ থাকা সত্বেও প্রতিবাদের ঝাণ্ডা হাতে তুলে নিয়ে এগিয়ে আসেনি তাঁরাই এখন মুজিবাদর্শের পতাকাবাহী তখন সামগ্রিকভাবেই আমরা শঙ্কিত না হয়ে পারি না। এবং এই শঙ্কার অবসান হওয়া দরকার। রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলেই এই শঙ্কা দূর করা সম্ভব। কাজেই আসুন, সকলে মিলে মুজিবাদর্শে ফিরে যাই। তা হলেই আমাদের সহযোদ্ধাদের আত্মাহতি, মা বোনদের ত্যাগ আর লাখো কোটি মানুষের সংগ্রামে অর্জিত বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে দৃপ্ত পদভারে।
লেখক, একজন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা, সংসদ সদস্য এবং সম্পাদক, মত ও পথ।