বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ড্রেজিং বিভাগের তত্ত্বাবধানে বরিশাল নদী বন্দর সংলগ্ন কীর্তনখোলা নদীতে ড্রেজিং করা হয় প্রতি বছরই। চলতি মৌসুমেও দক্ষিণাঞ্চলের ৩০টি স্থানের তালিকায় ওই স্থান খনন চলছে। ড্রেজার যেখানটায় চলে তার ঠিক বিপরীত দিকে বরিশাল সদর উপজেলার চরকাউয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের দুইটি গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে নদী ভাঙনে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে তাৎক্ষণিক জিও ব্যাগ ফেলা হলেও তা ভাঙনের তীব্রতার সামনে অপ্রতুল বলে মনে করেন বসতভিটা হারানো গ্রামবাসী। নূরজাহান বেগম নামে এক নারী বলেন, মেম্বার-চেয়ারম্যান-এমপি-মন্ত্রী কেউ নদী ভাঙন ঠেকাতে কাজ করে না। তারা শুধু আশ্বাস দেন। সামনে বর্ষার মৌসুম আসছে—ঘরে থাকতে পারব কিনা সেটাই তো জানি না। আমরা খুব আতঙ্কে আছি।
দেশের পানি সম্পদের সিংহভাগ বরিশাল বিভাগের নদীগুলোর ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। একই সঙ্গে মৎস্য সম্পদেরও উল্লেখযোগ্য অংশ এই অঞ্চলের নদী থেকেই আহরিত হয়। ফলে বিভাগের ছোট-বড় নদীগুলো জাতীয় অর্থনৈতিক চালিকা শক্তির অন্যতম উৎস। এসব নদী যে শুধু সম্পদের উৎস এমন নয়। এর ভয়াবহ উল্টো চিত্রও আছে। প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ বসতভিটা হারায় নদীর গ্রাসে।
বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় এমন ১৫৮টি ভাঙন ঝুঁকিপূর্ণ স্থান শনাক্ত করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। আসন্ন বর্ষার আগে এসব স্থানে ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে কমপক্ষে ১৫ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ১৫৮টি পয়েন্টের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পটুয়াখালী ও ভোলা জেলা। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, বিভাগের মধ্যে বরিশাল জেলায় ১০টি বাঁধ দুর্বল। আর পিরোজপুরে ১২টি, ঝালকাঠিতে ১০টি, পটুয়াখালীতে ৫৭টি, বরগুনা ২৬টি এবং ভোলায় ৪৩টি বাঁধ।
২০২০ সালে জলবায়ু ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস দক্ষিণাঞ্চলের ৩১টি নদী পথের দেড় হাজার কিলোমিটার এলাকায় সমীক্ষা চালায়। তাদের প্রতিবেদনে নাব্য সংকট যেমন উঠে এসেছে তেমনি নদী ভাঙনের ভয়াবহ চিত্রও উঠে এসেছে। নৌপথে ৪২ মিলিয়ন ঘন মিটার পলি অপসারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। একইসঙ্গে নদী পাড় সংরক্ষণে ৫ হাজার কোটি টাকা সরকারের বরাদ্দ দেওয়া উচিত বলে মনে করে প্রতিষ্ঠানটি।
বরিশাল বিভাগের ৪২টি উপজেলায় মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে আশ্রয়ণের প্রায় ৮০ হাজার ৫৮৪টি ঘর ভূমি ও গৃহহীনদের বিতরণ করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের সুফল ইতোমধ্যে পেতে শুরু করেছে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। যারা প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছেন তাদের অধিকাংশ নদী ভাঙনে ভূমিহীন বলে জানিয়েছে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়।
বাবুগঞ্জ উপজেলার সুগন্ধা নদীর তীরবর্তী ভূতেরদিয়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মজিদ বলেন, আমাদের জমিবিলীন হয়ে অপর তীরে নতুন জনপদ গড়ে উঠেছে। অথচ এই ২০-২২ বছরে কোন সহায়তা করেনি সরকার। আমরা শুধু নদী ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে শেষ হয়ে গেছি।
‘বর্ষা আসলেই বুকের মধ্যে মোচর দিয়ে ওঠে। এমন বর্ষায় আমাদের বসতভিটা বিলীন হয়ে গিয়েছিল’ বলেন আব্দুল মজিদ।
পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়নের আন্ধারমানিক নদীর তীরের বাসিন্দা ইউনুস কাজী। দুই বছর আগেও নদীর তীরে ঘর থাকলেও এখন উপজেলা সদরের একটি এলাকায় ভাড়া থাকেন। তিনি বলেন, দুই বছর আগে আন্ধারমানিক নদীর প্লাবনে আমার বসতঘর সব তলিয়ে যায়। এতে আমার তিন বছরের সন্তানটিও ডুবে মারা যায়। নদী পাড়ে আমরা যারা থাকি তাদের জীবন আসলে অমানবিক জীবনযাপন। কখন যে কী ঘটে যায় সেটাই বলতে পারি না।
বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং বিভাগের তথ্য মতে, এবার শুষ্ক মৌসুমের জন্য নদী খননের উদ্যোগ নেওয়া ৩০টি স্থানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বরিশাল নৌবন্দর, পটুয়াখালী নৌবন্দর, কারখানা নদীবন্দর, আপেলকাঠী, কবাই, বরগুনার খাগদন নদী, আমতলী ফেরিঘাট, লাহারহাট-ভেদুরিয়া চ্যানেল, ইলিশা ঘাট, ভোলা খেয়াঘাট, লালমোহন, নাজিরপুর, রাঙ্গাবালী, শ্রীপুরের লালবাগ, কালাবদরের মুখে, হিজলা-মৌলভীরহাট, মিয়ার চর।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বরিশাল বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মুজিবুর রহমান জানান, বিভাগের মধ্যে এই বছর সবচেয়ে বেশি ভাঙন কবলিত মেঘনা নদীর তীরবর্তী মনপুরা, হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জ, পায়রা নদীর তীরবর্তী তালতলী উপজেলা, আগুনমুখা নদীর তীরবর্তী গলাচিপা ও রাঙ্গাবালি উপজেলা। হিজলা উপজেলায় ভয়াবহ নদী ভাঙনের মুখে রয়েছে। মাত্র এক কিলোমিটার দূরেই উপজেলা পরিষদ ভবন।
এই কর্মকর্তা বলেন, বিভাগের শনাক্ত দেড় শতাধিক দুর্বল বেড়িবাধের স্থানে ভাঙন ঠেকাতে প্রায় ৬৭ কোটি টাকার মত বরাদ্দ চেয়েছি। এছাড়া হিজলা উপজেলার বাউশিয়া, হরিনাথপুর এলাকায় ভাঙনরোধে স্থায়ী পরিকল্পতা বাস্তবায়নে ৭৩৬ কোটি ৮৩ লাখ এবং বাবুগঞ্জ উপজেলার সন্ধ্যা নদীর ভাঙনমুখে থাকা বরিশাল বিমানবন্দর এলাকা রক্ষায় ৫০ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পগুলো পাস হলে দক্ষিণাঞ্চলে নদী ভাঙন অনেকাংশে কমে আসবে।