নৃশংস আচরণ প্রতিরোধে আমাদের করণীয়

ড. নিয়াজ আহম্মেদ

ড. নিয়াজ আহম্মেদ

নেত্রকোনার বারহাট্রা উপজেলায় বড় বোনকে উত্ত্যক্তের পর ছোট বোনকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে এক বখাটে যুবকের বিরুদ্ধে। মেয়েটিকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনাটি মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক এবং চরম নৃশংস। আমরা প্রায়ই সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও বয়সের কারো কারো দ্বারা এমন নৃশংস আচরণ লক্ষ করি। কেউ সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যায়, আর কারো ক্ষেত্রে মৃত্যুর মতো করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়।

সমাজে বিরাজমান সামাজিক অপরাধের ধরনগুলোর মধ্যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড অন্যতম। আমাদের আগের ধারণা, শিশু-কিশোররা ছোটখাটো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাদের আচরণের মধ্যে নৃশংসতা খুঁজে পাওয়া যায় না। সাধারণত সমাজে দাগি আসামি কিংবা বংশপরম্পরায় নৃশংস আচরণগুলো ঘটে থাকে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে আমাদের অতীতের ধারণায় চিড় ধরছে। অপরাধবিজ্ঞানীরা কিশোর অপরাধ ও অপরাধের মধ্যে পার্থক্য খুঁজতে গিয়ে বয়স এবং অপরাধের ধরনকে প্রাধান্য দিতেন। কিন্তু এখনকার সময়ে অপরাধের ধরন ও মাত্রা বিবেচনায় পার্থক্য বের করা মুশকিল। ফলে কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে সামাজিক ও আইনগত করণীয় বিষয়কে নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে। অনেকে মনে করেন, কিশোর অপরাধীদের সাজার পরিবর্তে সংশোধনকে বেশি প্রাধান্য দেওয়ার আইনগত দিকটি নতুন করে ভাবা উচিত। বিষয়টি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান মডেলের ব্যাখ্যা, মানসিক বিকারগ্রস্ত না হলে একজন ব্যক্তি নৃশংস আচরণে নিজেকে জড়াতে পারে না। ব্যক্তি যখন সমাজের বিভিন্ন অবস্থা ও ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে চলতে ব্যর্থ হয়, তখন তার মধ্যে একটি ভিন্ন অবস্থা তৈরি হয়। এমন ভিন্ন অবস্থা তার ক্রটিপূর্ণ ব্যক্তিত্বের ফসল। তখন ব্যক্তির মধ্যে অস্বাভাবিকতা জন্ম লাভ করে। ফলে ব্যক্তি যেকোনো অপরাধমূলক কাজে নিজেকে যুক্ত করতে পারে। নৃশংস আচরণকে কোনোভাবেই এ থেকে বাদ দেওয়া যায় না। সামাজের বিভিন্ন পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে শিশু-কিশোরদের সামঞ্জস্য বিধান করতে না পারার ব্যর্থতা পরিবার ও সমাজ কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।

আমরা শিশু-কিশোরদের এমন একটি পরিবার, পরিবেশ ও সমাজ উপহার দিচ্ছি, যেখানে অনেকের পক্ষে নিজেকে সুন্দরভাবে তৈরি করা কিংবা খাপ খাইয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তখন তাদের মধ্যে তৈরি হয় মানসিক বিকারগ্রস্ততা ও হতাশা, যা তাকে বাধ্য করে হত্যার মতো নৃশংস আচরণ করতে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে এমন মনোজগৎ তৈরি হওয়ার পেছনে সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলোর ভূমিকাও অনেক। কেননা বিদ্যমান অবস্থার কারণে সমাজে প্রচলিত প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী অপরাধ প্রতিকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। অনেকের মধ্যেই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে না পারার ব্যর্থতা থেকে যাচ্ছে। অপরাধ এবং একে কেন্দ্র করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নতুন কোনো অপরাধ করা থেকে বিরত রাখার কোনো দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারছে না।

পরিবারকে একটি সিস্টেম হিসেবে আমরা বিবেচনা করে আসছি। এই সিস্টেমের অধীনে রয়েছে আরো অনেক সাব-সিস্টেম, যার মূলে পরিবার। আর বৃহৎ পরিসরে রয়েছে সমাজ। পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোনের মতো সাব-সিস্টেম নিয়ে আমাদের পরিবার। পরিবারের মূল ভিত্তি সম্পর্ক।

নৃশংস আচরণ প্রতিরোধে আমাদের করণীয়বর্তমান সময়ে আমাদের বড় সংকট সম্পর্কের পরিচর্যা না করা। আমরা অনেক কিছুর পরিচর্যা করি, কিন্তু সম্পর্কের পরিচর্যার প্রতি আমাদের যেন অবহেলা। যেমন—আমরা নিয়মিত গাছের পরিচর্যা করি। আমার বাড়ির ছাদে বাগান থাকলে তারও পরিচর্যা করি। আমার বাসাকে সুন্দর করে আমি সাজাই। আমার ব্যক্তিগত গাড়িরও পরির্চযা করি। সব কিছু যেন নিখুঁত হওয়া চাই। কিন্তু আমাদের পরিবার ও সমাজে যে বিভিন্ন ধরনের সম্পর্ক রয়েছে তার পরিচর্যা করতে যেন আমরা ভুলে যাই। ফলে সম্পর্কের পরিচর্যার অভাবে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়। পরিবারের কোনো কোনো সদস্য নিজেকে পরিবার থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে কিংবা পরিবারের বাইরে কারো সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিশু-কিশোররা ব্যর্থ হয়। তখন তাদের মধ্যে মানসিক বিকারগ্রস্ততা তৈরি হয়। নিজেকে স্থান করে নেয় নেশার জগতে কিংবা নৃশংস কোনো অপরাধমূলক কাজে।

বিভিন্ন কারণে আমাদের সমাজে যৌথ পরিবারব্যবস্থার পরিবর্তে একক পরিবার গঠিত হচ্ছে। একক পরিবারের ছোট-বড় সব সদস্যই কমবেশি স্বাধীনতা ভোগ করে। কেননা এখানে ভালো-মন্দ দেখা ও বলার মতো বয়োজ্যেষ্ঠ কাউকে পাওয়া যায় না, যা তাদের মধ্যকার সম্পর্কের ওপর বড় প্রভাব বিস্তার করে। যৌথ পরিবার তৈরি হলেও যদি পরিবারের সব সদস্যের মধ্যে আন্ত সম্পর্ক বজায় থাকে, তাহলেও কোনো সংকট সহজে মোকাবেলা করা যায়। পরিবারে আর্থিক, সামাজিক ও সংকটসহ অনেক বিষয় থাকে, যা আলোচনা করে সমাধান করা যায়। মোটকথা সম্পর্কই এখানে বড় বিষয়। যৌথ কিংবা একক খুব বেশি বড় নয়।

একটি নির্দিষ্ট বিরতিতে সবাই একত্রে মিলিত হওয়া এবং কোনো সংকটে মন খুলে কথা বলা ও আলোচনা করাই পারে দূরে থেকেও একটি সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখতে। এমনিভাবেই বেশির ভাগ পরিবার সুন্দরভাবে টিকে আছে। আমরা যদি সম্পর্ককে বেশি প্রাধান্য দিতে পারি এবং সম্পর্কের মধ্যেই সমাধান খুঁজি, তাহলে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অনেক সমস্যার সমাধান বের হয়ে আসবে। ব্যক্তিগত অক্ষমতা, পরিবারের অবহেলা কিংবা সামাজিক অসংগতি, যাকে আমরা নৃশংস সামাজিক অপরাধের কারণ মনে করি, যার মূলে রয়েছে পরিবারের প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের সম্পর্কের অভাব।

আমরা যদি সমাজ থেকে নৃশংস আচরণ দূর করতে চাই, তাহলে আমাদের সম্পর্কের ওপরই জোর দিতে হবে। আমাদের সম্পর্কের চর্চা ও লালন করতে হবে, যাতে কেউ নিজেকে একা না মনে করে। শিশু-কিশোররা যখন সুন্দর সম্পর্কের মধ্যে নিজেকে দেখবে তখন তার মধ্যে কোনো হতাশা কাজ করবে না। নিজেদের মানসিক বিকারগ্রস্ত ভাববে না। নিজেকে যুক্ত করবে না কোনো অপরাধমূলক কাজে। বরং ভালো কাজে নিজেকে তৈরি করবে। আসুন, আমরা আমাদের সন্তানদের একটি সুন্দর সম্পর্কযুক্ত পরিবার ও সমাজ উপহার দিই।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

neazahmed_2002@yahoo.com

শেয়ার করুন