নির্বাচন না করে বিএনপি কীভাবে ক্ষমতায় পরিবর্তন আনবে?

মোনায়েম সরকার

মোনায়েম সরকার
মোনায়েম সরকার। ফাইল ছবি

জাতীয় নির্বাচনের আর ছয় মাসের মতো বাকি। এই নির্বাচন যাতে অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও অবাধ হয় তা নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে অনেকেরই আগ্রহ আছে। তবে বিএনপির মতো একটি বড় দল যদি না আসে তাহলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হওয়ার ক্ষেত্রে বড় প্রশ্ন উঠবে। বিএনপির ব্যাপারে আওয়ামী লীগের যত খারাপ ধারণাই থাক না কেন, আমেরিকাসহ পশ্চিমা কিছু দেশের বিএনপির প্রতি সহানুভূতি আছে।

আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপির সঙ্গে চলতে ওইসব দেশ সব সময় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বিশ্বশক্তির যে বিভাজন তৈরি হয়েছিল তার অবসান হয়নি, বরং স্বায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী পরিবর্তিত বিশ্ব প্রেক্ষাপটে তার মাত্রা ও রং বদলেছে। দেশের মধ্যেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক নৈকট্য না বেড়ে দূরত্ব বেড়েছে। রাজনৈতিক বিরোধিতা কার্যত শত্রুতায় পরিণত হয়েছে।

আওয়ামী লীগের মধ্যে ইতিবাচক কিছু দেখে না বিএনপি। কারণ আওয়ামী লীগবিরোধিতাকে পুঁজি করেই বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটির জন্ম। আওয়ামী লীগকে হেয় করতে না পারলে, আওয়ামী লীগের পায়ের নিচ থেকে মাটি না সরালে বিএনপির দাঁড়ানোর জায়গা হয় না। বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে বিএনপির প্রত্যক্ষ সংযোগ না থাকলেও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানই বঙ্গবন্ধু হত্যার সবচেয়ে বড় বেনিফিশিয়ারি। জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না, এটা জোর দিয়ে বলা যাবে না। আওয়ামী লীগ সব সময়ই জিয়াকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ করে এসেছে।

বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপির সামনে সুযোগ ছিল দলকে নতুন রাজনৈতিক ধারায় সজ্জিত করার। মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে স্বীকার করে নিলে বিষয়টি অনেক সহজ হয়ে যায়। অথচ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বেও বিএনপি চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে সেই আওয়ামী লীগবিরোধিতারকেই রাজনীতির মূল উপাদান হিসেবে ধরে রেখেছে।

খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকাকালে শেখ হাসিনাকেও হত্যা চেষ্টায় জড়িয়ে এবং পরবর্তী সময় অহিংস আন্দোলন চালিয়ে এমন এক অবস্থানে এসেছে যা দলটিকে আর সুস্থতার পথে চলতে দিচ্ছে না। আওয়ামী লীগ আর যে রাজনৈতিক দলকেই বিশ্বাস করুক না কেন, বিএনপিকে কোনোভাবেই বিশ্বাস করে না।

এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপ বা সমঝোতার প্রত্যাশা যারা করেন, তারা রাজনীতির অ আ ক খও বোঝেন বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটা একাধিকবার স্পষ্ট করেই বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে আলোচনার কিছু নেই।

আগামী নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মুখোমুখি অবস্থানে। বিএনপি চাইছে সরকার পতন। আন্দোলনের মাধ্যমেই তারা সরকারের পতন ঘটাতে চায়। তবে এটা সম্ভব কি না তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে সংশয় রয়েছে। তুমুল গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন হয় না, তা নয়। কিন্তু এখন বিএনপির যে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক অবস্থা তাতে তাদের পক্ষে সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব বলে কোনো রাজনৈতিক জ্যোতিষীও মনে করেন না।

কেন সেটা করেন না? প্রথম কারণ বিএনপির আসল নেতা কে তা এখন মানুষের কাছে স্পষ্ট নয়। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী খালেদা জিয়া এখনো দলের চেয়ারপারসন। কিন্তু তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বানানোর কারণে খালেদা জিয়াকে সাইডলাইনে রেখে দলের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছেন লন্ডনপ্রবাসী তারেক রহমান। তিনি এখন ‘অনলাইন’ রাজনীতি করছেন।

কারাগারে না থেকেও রাজনৈতিক তৎপরতা থেকে বিরত রয়েছেন খালেদা জিয়া। আর দেশে উপস্থিত না থেকে ভার্চুয়ালি দল চালাচ্ছেন তারেক রহমান। সরকার পতন আন্দোলনে খালেদা জিয়ার সম্পৃক্ততা থাকবে কি না এমন প্রশ্নে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের স্পষ্ট জবাব- ‘প্রশ্নই ওঠে না, এখন তো প্রশ্নই ওঠে না’।

তাদের মতে, পরিপূর্ণভাবে মুক্ত হলেই খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে ফেরা সম্ভব। কিন্তু খালেদা জিয়ার মুক্তি কবে, কীভাবে? সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপিপ্রধানের রাজনীতিতে ফেরার বিষয়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত থাকার পরও এ নিয়ে দলের সিনিয়র নেতারা কেন এত বিব্রত? তবে কি খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে ফিরে আসা চায় না বিএনপি নেতৃত্ব?

বিএনপি সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। দলটি ছোট ছোট অসংখ্য দল নিয়ে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে। শিগগির নাকি আন্দোলনের জোয়ারে আওয়ামী লীগ সরকার ভেসে যাবে। কিন্তু বাস্তবে সরকারের বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে রাজপথে জনস্রোত নামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ১৪ মে গুলশানে দলীয় চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে খালেদা জিয়ার কোনো পরামর্শ আছে কি না? জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেশ রাগান্বিত ভঙ্গিতে বলেন, আপনাদের বহুবার বলা হয়েছে- আমাদের ম্যাডাম অসুস্থ, তিনি এখন গৃহবন্দি। দলের কর্মসূচি নেওয়া ও পালনের ক্ষেত্রে তার পরামর্শ নেওয়ার সুযোগ নেই। তাকে বারবার ভিন্ন ট্র্যাকে নিয়ে আসছেন কেন?

‘তিনি (খালেদা জিয়া) একজন স্বাধীন মানুষ, তিনি কী করবেন, সেটা আমার বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না’- আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের এমন বক্তব্যের পরই খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে ফেরা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। চারজন মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের সিনিয়র একজন নেতা প্রকাশ্যে এ নিয়ে কথা বলেছেন। তাদের বক্তব্য, খালেদা জিয়ার মুক্ত থাকার শর্তে যা আছে, তাতে তার রাজনীতি করতে বাধা নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এমন বক্তব্য আসার পরও খালেদা জিয়াকে কেন প্রকাশ্যে আনা থেকে বিরত রয়েছে বিএনপি?

তবে গত তিন বছরে দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতা মাঝে মধ্যে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করলেও তিনি রাজনৈতিক বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। তবে মির্জা ফখরুল তার সঙ্গে মাসে দু-তিনবার দেখা করছেন। দলের সব বিষয়ে তার সঙ্গে আলোচনা ও পরামর্শ করছেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বক্তব্যের পরই মূলত খালেদা জিয়া রাজনীতিতে ফেরার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। দলের ত্যাগী অথচ কোণঠাসা নেতাদের বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছেন। সম্প্রতি বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত অন্যতম নেতা নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন। সেখানে খালেদা জিয়া দলের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে কথা বলেছেন, তার বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, খালেদা জিয়ার রাজনীতির প্রশ্ন এলেই বিএনপির বেশির ভাগ নেতা এড়িয়ে যান। অনেকেই সরাসরি বলেন, ‘এ প্রসঙ্গে কথা না বলি’। তবে ‘অন দ্য রেকর্ডে’ তারা যা বলেন তা হলো অসুস্থতা, মামলা জটিলতা ও বয়সের কারণে খালেদা জিয়া দলের নেতৃত্বে সক্রিয় হতে পারবেন না। তিনি নিজেই কারাগারে যাওয়ার আগে ছেলে তারেক রহমানকে দলের দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। তারেক রহমান বিদেশে থেকেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন দলের তৃণমূলে। যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোও এখন তার হাতের মুঠোয়।

দলের ভেতরে যারা প্রথমে তারেক রহমানের নেতৃত্ব মানতে চাননি তারাও এখন তার নির্দেশ মোতাবেক কাজ করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন বলে শোনা যায়। তাই নতুন করে খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার বিষয়টি দলের জন্য বিব্রতকর। তাছাড়া নেতাদের শঙ্কা- সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীনরা খালেদা জিয়াকে ‘কার্ড’ হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করতে পারেন। খালেদা জিয়াকে রাজনীতি করতে দেওয়া নিয়ে মন্ত্রীদের বক্তব্যকে একটা ‘ফাঁদ’ হিসেবে দেখছেন বিএনপির কোনো কোনো নেতা।

‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নেতৃত্বেই দল পরিচালিত হচ্ছে এবং সেভাবেই আমরা কাজ করছি’- এমনটা জানিয়ে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, তারেক রহমানের নেতৃত্বেই বিএনপি এবার শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার অবস্থানে অটল থেকে তাদের যুগপৎ আন্দোলনের একটা পরিণতি দেখতে চাইছে। এর কোনো একপর্যায়ে যদি খালেদা জিয়াকে বাসা থেকে বের করে অন্তত গুলশান কার্যালয় পর্যন্ত আনা যায় তবে নিঃসন্দেহে আন্দোলনে নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ সৃষ্টি হবে। কিন্তু এভাবে খালেদা জিয়াকে বাসা থেকে বের করা হলে তাকে আবার জেলে পাঠানো এবং আন্দোলন দমনে সরকারের পক্ষে কঠোর অবস্থান নেওয়ার সুযোগ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করছে বিএনপি। সেই অবস্থায় আন্দোলন এগিয়ে নেওয়া কঠিন হবে। এছাড়া তারেক রহমানের নেতৃত্বও তখন দলের ভেতরেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।

প্রশ্ন হলো, বিএনপি কেন নির্বাচনকেও আন্দোলনের অংশ হিসেবে ভাবছে না? সরকার পতনের পাশাপাশি নির্বাচনে অংশ নিয়েও তো সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলা যায়। তাছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার পরিবর্তনের নিয়মতান্ত্রিক পথ তো নির্বাচনই। দেশের শাসন কাজ পরিচালনা করবে রাজনৈতিক সরকার আর নির্বাচন পরিচালনা করবে অরাজনৈতিক সরকার- এই দ্বিমুখী নীতি বিএনপিকে পরিহার করতে হবে।

বিএনপি আওয়ামী লীগের শাসনের নিন্দা-সমালোচনায় যতটা মুখর, নিজেরা ক্ষমতায় গিয়ে কীভাবে এরচেয়ে ভালো বা উৎকৃষ্ট শাসন উপহার দেবে, সে ব্যাপারে ততটাই নীরব। বিএনপি বা তার মিত্ররা মিলে ক্ষমতায় গেলে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, ঘুস-দুর্নীতি বন্ধ হবে, মূল্যবৃদ্ধির সিন্ডিকেট থাকবে না, বিরোধী মত দমনে কোনো কালো আইনের আশ্রয় নেওয়া হবে না, পুঁজি পাচার বন্ধ হবে- এমন নিশ্চয়তা না দিয়ে শুধু সরকারকে গালমন্দ করলে কিছু মানুষের বাহবা পেলেও গণআন্দোলনে গতিবেগ সঞ্চার হবে বলে মনে হয় না।

২২ মে, ২০২৩

লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর।

শেয়ার করুন