সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির সোপানে নিয়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধির পথ রচনা করেছিলেন। এরপর তিনি জাতিকে উন্নয়নের মহাসড়কেও তুলে দেন। পূর্বসূরির দেখানো পথ ধরে বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল নিজের প্রথম বাজেটে জাতিকে ‘সমৃদ্ধির সোপানে’ নিয়ে যান। তবে করোনা মহামারির প্রভাবে অর্থনীতির অগ্রযাত্রা থমকে দাঁড়ায়। এরপর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেন মুস্তফা কামাল। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শেষে এখন স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা শুরু করলেন অর্থমন্ত্রী।
১ জুন (বৃহস্পতিবার) জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। আগামী অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেটের শিরোনাম করা হয়েছে ‘উন্নয়নের অভিযাত্রার দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা’। চারটি মূল স্তম্ভের ওপর স্বপ্নের স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে রয়েছে- স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট সোসাইটি ও স্মার্ট ইকোনমি।
এই স্মার্ট বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় হবে কমপক্ষে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার। দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকবে ৩ শতাংশের কম মানুষ। আর চরম দারিদ্র্য নেমে আসবে শূন্যের কোঠায়। মূল্যস্ফীতি সীমিত থাকবে ৪-৫ শতাংশের মধ্যে। বাজেট ঘাটতি থাকবে জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে। রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত হবে ২০ শতাংশের ওপরে। বিনিয়োগ হবে জিডিপির ৪০ শতাংশ। এমন স্বপ্নই দেখালেন অর্থমন্ত্রী।
শতভাগ ডিজিটাল অর্থনীতি আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক সাক্ষরতা অর্জিত হওয়ার কথাও শুনিয়েছেন মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, সবার দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে যাবে। স্বয়ংক্রিয় যোগাযোগ ব্যবস্থা, টেকসই নগরায়ণসহ নাগরিকদের প্রয়োজনীয় সব সেবা থাকবে হাতের নাগালে। তৈরি হবে পেপারলেস ও ক্যাশলেস সোসাইটি। সবচেয়ে বড় কথা, স্মার্ট বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা।
অর্থমন্ত্রী বলেন, সব ধরনের দৈব-দুর্বিপাকে ভয়হীন, ঘুরে দাঁড়াবার ঐকান্তিক স্পৃহায় বলিয়ান, প্রত্যয়ী আর সৃজনশীল জনসাধারণই বাংলাদেশের অন্তহীন প্রেরণার উৎস। যাদের বিন্দু বিন্দু ঘামের বিনিময়ে, চেষ্টায়, ত্যাগ-তিতিক্ষায় এ দেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে সেই কৃষক, শ্রমিক, মজুর, ব্যবসায়ী, শিল্প মালিক, টেকনিশিয়ান, ড্রাইভার, মিস্ত্রী, কামার, কুমার, জেলে, বেদে, মুচি, ঋষি, ধোপা, তাঁতি, কাসারু, শাখারি, স্বর্ণকার, মাঝি, ঘরামি, কাহার, করাতি, পাতিয়ালসহ সব শ্রেণি-পেশা ও নৃগোষ্ঠীর মানুষই বাংলাদেশের সম্পদ ও প্রাণশক্তি। সবার ঐকান্তিক সহযোগিতায় শূন্য থেকে ধীরে ধীরে মহিরুহে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। সব মানুষের আশা-প্রত্যাশা ও উন্নয়ন ভাবনার প্রতিফলন ঘটানোর প্রত্যয়ে সাজানো হয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট।
বাংলাদেশকে একসময় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলেছিলেন মার্কিন কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার। সেই বাংলাদেশ এখন বদলে গেছে, বদলে যাচ্ছে। সমৃদ্ধির পথ ধরে উন্নয়নের মহাসড়কে উঠে এখন বাংলাদেশ হবে স্মার্ট। এই স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়ে অর্থমন্ত্রী ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার যে বাজেট প্রস্তাব দিয়েছেন, সেখানে সামগ্রিক ঘাটতি (অনুদান ব্যতীত) ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ২০ শতাংশের সমান। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হয় ২ লাখ ২৭ হাজার ৫০৭ টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ১০ শতাংশ।
এই ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ২৭ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। বিপরীতে ২৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। তাতে নিট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে এক লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। এছাড়া ৩ লাখ ৯০০ কোটি টাকা বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার যাবে বলে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী।
অপরদিকে অভ্যন্তরীণ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে এক লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা নেওয়া হবে। যার মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৮৬ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা এবং স্বল্পমেয়াদি ঋণ ৪৫ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাংক বহির্ভূত ২৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হবে। সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়া হবে ১৮ হাজার কোটি টাকা।
নতুন অর্থবছরের বাজেটে ৫ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে কর বাবদ ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা এবং কর ব্যতীত ৫০ হাজার কোটি টাকা আসবে বলে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী। কর বাবদ যে রাজস্ব আসবে তার মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত কর ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং ২০ হাজার কোটি টাকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বহির্ভূত কর।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে পরিচালন ব্যয় বাবদ ৪ লাখ ৭৫ হাজার ২৮১ কোটি টাকা রেখেছেন অর্থমন্ত্রী। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ বাবদ ৮২ হাজার কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণের সুদ বাবদ ১২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা ব্যয় হবে। পাশাপাশি মূলধন ব্যয় ৩৯ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। ঋণ ও অগ্রিম বাবদ ব্যয় হবে ৮ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। এছাড়া খাদ্যে ব্যয় হিসেবে ৫০২ কোটি টাকা রাখা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাবদ ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বিভিন্ন স্কিম বাবদ রাখা হয়েছে ৩ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা। এডিপি বহির্ভূত বিশেষ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৭ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। এছাড়া কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে (এডিপি বহির্ভূত) ২ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে তরুণ-তরুণী ও যুবসমাজকে প্রস্তুত করতে চায় সরকার। এ জন্য প্রস্তুতির অংশ হিসেবে গবেষণা, উদ্ভাবন ও উন্নয়নমূলক কাজের জন্য আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ১০০ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।
রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের ওপর শুল্ক কর অথবা ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে আগামীতে লেখার কলম, ফেসিয়াল টিস্যু, টয়লেট টিস্যু, সিমেন্ট, কাজু বাদাম, বাসমতি চাল, চশমা, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, এলপি গ্যাস সিলিন্ডার, প্লাস্টিকের পাত্র, অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র, সিগারেট, জর্দা-গুল, খেজুর, বিদেশি টাইলস, মোবাইল ফোনসহ বেশি কিছু নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম আগামীতে বাড়তে পারে।
অধিক সংখ্যক মানুষকে করজালে আটকাতে আগামী অর্থবছর থেকে সরকারি-বেসরকারি ৪৪টি সেবা পেতে রিটার্ন জমার স্লিপ বা প্রাপ্তি স্বীকারপত্র বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। আগামী ১ জুলাইয়ের পর থেকে রিটার্ন জমার স্লিপ পেতে করযোগ্য আয় না থাকলেও ২ হাজার টাকা ন্যূনতম কর দিতে হবে।
প্রবাসী বাংলাদেশি বা দেশের বাইরে বেড়াতে গিয়ে অনেকেই সোনার অলংকার বা বার নিয়ে আসেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে এমনটা বেশি হয়ে থাকে। এখন থেকে দেশের বাইরে থেকে সোনা আনলে আগের তুলনায় দ্বিগুণ কর পরিশোধ করতে হবে। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে প্রতি ভরি সোনায় ৪ হাজার টাকা কর প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে প্রতি ভরি সোনায় কর দিতে হয় দুই হাজার টাকা।
এছাড়াও প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তি পর্যায়ে সোনা আনার পরিমাণও কমানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। বর্তমানে সর্বোচ্চ ২৩৪ গ্রাম বা ২০ দশমিক শূন্য ৬ ভরি পর্যন্ত সোনা আনা যায়। আগামী অর্থবছরে তা কমিয়ে ১১৭ গ্রাম বা ১০ দশমিক শূন্য ৩ ভরি করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়ে অর্থমন্ত্রী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট দিয়েছেন, সেখানে উচ্চপ্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা করছেন। সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা।
উচ্চপ্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরার কারণ হিসেবে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, ধীরে হলেও বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বিশেষ করে আমাদের বাণিজ্য ও প্রবাসী আয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোতে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে প্রক্ষেপণ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্য, সার ও জ্বালানির মূল্য স্বাভাবিক হয়ে আসার সুবাদে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাবে বলেও আইএমএফের প্রক্ষেপণে প্রকাশ পেয়েছে।
তিনি বলেন, বিশ্ব অর্থনীতির অনুকূল পরিবর্তন আমাদের জন্য আশার সঞ্চার করছে। একই সঙ্গে কোভিড পরিস্থিতির সার্বিক উন্নয়নে দেশের অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পূর্ণ গতি সঞ্চার হয়েছে। এছাড়াও অর্থবছরের শেষাংশে কৃষিখাতে ভালো ফলন আসছে। সার্বিকভাবে উৎপাদশীল খাতে বিনিয়োগ ও উৎপাদশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এবং সুসংহত অভ্যন্তরীণ চাহিদার কল্যাণে পূর্বের ধারাবাহিকতায় আগামী অর্থবছরে আমরা উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসবো। আগামী অর্থবছরে সাড়ে ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব বলেও আশা প্রকাশ করেন মন্ত্রী।
মুস্তফা কামাল বলেন, প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমরা ক্রমান্বয়ে কৃচ্ছ্রসাধন নীতি থেকে বের হয়ে এসে মেগাপ্রকল্পসহ প্রবৃদ্ধি সঞ্চারক চলমান ও নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ করবো। এ উদ্দেশ্যে আগামী অর্থবছরের বাজেটে সরকারি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি করে জিডিপির ৬ দশমিক ৩০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ তৈরি, যেমন নিষ্কণ্টক জমি, উন্নত অবকাঠামো, নিরবচ্ছিন্ন ইউটিলিটি, আর্থিক প্রণোদনা ও সহজ ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধাসহ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ সুবিধা প্রদান অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, লজিস্টিকস খাতের উন্নয়ন ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার সংস্কারের ফলে বিনিয়োগ/ব্যবসা প্রক্রিয়াকরণে সময়, ব্যয় ও জটিলতা কমবে। ফলে চলতি বছরে কিছুটা কমে আসা বেসরকারি বিনিয়োগ আমামী বছরে বেড়ে হবে জিডিপির ২৭ দশমিক ৪০ শতাংশ।
বর্তমানে নিত্যপণ্যের উচ্চ মূল্যের কারণে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছে মূল্যস্ফীতির চাপে। আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের কাছাকাছি থাকবে বলে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী। এ বিষয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি, খাদ্যপণ্য ও সারের মূল্য কমে আসা, দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় এবং খাদ্য সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য সরকারি উদ্যোগের প্রভাব আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত থাকবে। আগামী অর্থবছরে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের কাছাকাছি দাঁড়াবে বলে আশা করছি।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে। পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের ১৩ দশমিক ৭০ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে এ খাতের জন্য। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সুদ। এ খতের জন্য বরাদ্দ ১২ দশমিক ৪০ শতাংশ। সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়ার তালিকায় রয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ এবং ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতও। পরিবহন ও যোগাযোগে বাজেটের ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে ১১ দশমিক ১০ শতাংশ বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়া জনপ্রশাসনে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যণে ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায় ৪ দশমিক ১০ শতাংশ, গৃহায়ণে এক শতাংশ, বিনোদন সংস্কৃতি ও ধর্মে শূন্য দশমিক ৭০ শতাংশ, শিল্প ও অর্থনৈতিক সার্ভিসে শূন্য দশমিক ৭০ শতাংশ, পেনশনে ৪ দশমিক ৩০ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এছাড়াও বিবিধ ব্যয় ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ, স্থানীয় সরকার ও পল্লি উন্নয়নে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ, জ্বালানি ও বিদ্যুতে ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ, স্বাস্থ্যে ৫ শতাংশ, কৃষিতে ৩ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং প্রতিরক্ষয় ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়ে অর্থমন্ত্রী সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম যৌক্তিকভাবে সাজানোর চেষ্টা করেছেন। এ লক্ষ্যে আগামী অর্থবছরে বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা নারী, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভাতাভোগীর সংখ্যা এবং টাকার পরিমাণ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন মুস্তফা কামাল।
বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা ৫৭ লাখ ১ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫৮ লাখ ১ হাজার জন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তাদের মাসিক ভাতার হার ৫০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা নারী ভাতাভোগীর সংখ্যা ২৪ লাখ ৭৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ২৫ লাখ ৭৫ হাজার করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ খাতে সুবিধাভোগীদের মাসিক ভাতা ৫০০ টাকা থেকে ৫৫০ টাকা করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।
একই সঙ্গে প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর সংখ্যা ২৩ লাখ ৬৫ হাজার থেকে ২৯ লাখ করার কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। পাশাপাশি প্রতিবন্ধী ডাটাবেজের আওতাভুক্ত সবাইকে এ ভাতার আওতায় আনার কথা বলেন তিনি। প্রতিবন্ধী ছাত্র/ছাত্রীদের মাসিক শিক্ষা উপবৃত্তির হার বাড়িয়ে প্রাথমিক স্তরে ৭৫০ টাকা থেকে ৯০০ টাকা, মাধ্যমিক স্তরে ৮০০ টাকা থেকে ৯৫০ টাকা এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ৯০০ টাকা থেকে ৯৫০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর ভাতাভোগীর সংখ্যা ৪ হাজার ৮১৫ জন থেকে ৬ হাজার ৮৮০ জনে উন্নীত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বিশেষ ভাতাভোগীর সংখ্যা ২ হাজার ৬০০ জন থেকে ৫ হাজার ৬২০ জনে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এবার তিনি জানিয়েছেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকেই বাংলাদেশে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করা সম্ভব হবে। প্রস্তাবিত স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হলে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী একজন সুবিধাভোগী ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত এবং ৫০ বছরের অধিক বয়স্ক একজন সুবিধাভোগী ন্যূনতম ১০ বছর পর্যন্ত চাঁদা দেওয়ার সাপেক্ষে আজীবন পেনশন সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।
এতে প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশি নাগরিকরাও অংশ নিতে পারবেন। পেনশনে থাকাকালীন ৭৫ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগে মৃত্যুবরণ করলে পেনশনারের নমিনি পেনশনারের ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার অবশিষ্ট সময় পর্যন্ত টাকা পাবেন। চাঁদাদাতা কমপক্ষে ১০ বছরের চাঁদা দেওয়ার আগে মৃত্যুবরণ করলে জমা করা অর্থ মুনাফাসহ নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে। চাঁদাদাতার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জমা করা অর্থের সর্ব্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ হিসেবে উত্তোলন করা যাবে।
ব্যক্তি করদাতের ক্ষেত্রেও কিছুটা সুখবর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া বেশ কিছু পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) ও শুল্ক কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে সামনে হাতে তৈরি বিস্কুট-কেক, মিষ্টি, ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মার ওষুধ, পশুখাদ্য, অপটিক্যাল ফাইবার, উড়োজাহাজ ইজারা, কনটেইনার এবং অন্যান্য গৃহস্থালি সরঞ্জামের দাম কমতে পারে।
অর্থমন্ত্রী ব্লেন্ডার, জুসার, প্রেশার কুকারের মতো গৃহস্থালি সরঞ্জাম উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা আরও দুই বছর (২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত) বহাল থাকার প্রস্তাব করেছেন। একই সুবিধা পাবে ওয়াশিং মেশিন এবং মাইক্রোওয়েভ ও ইলেকট্রিক ওভেন উৎপাদনকারী কারখানা। তথ্যপ্রযুক্তি ও কম্পিউটার পণ্য উৎপাদনে অব্যাহতি সুবিধা তিন বছর (২০২৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত) বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়া রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার উৎপাদনে এখনকার ৫ শতাংশের অধিক ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধার মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। স্যানিটারি ন্যাপকিন ও ডায়াপার তৈরির কাঁচামাল আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এছাড়াও সাবান এবং শ্যাম্পু তৈরির দুটি কাঁচামালে ৫ শতাংশের অতিরিক্ত ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা এক বছর বহাল রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।