দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের রাজনীতিতে ভেতরে ভেতরে নানা ভাঙা গড়ার খেলা চলছে। বাইরে থেকে সবটুকু এখনো দৃশ্যমান না হওয়ায় এ নিয়ে এখনই চূড়ান্ত মন্তব্য করা যাবে না। তবে নানা জনের নানা কথা, সংবাদপত্রে সব প্রকাশ না হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব মন্তব্য-প্রতিক্রিয়া, মতামত প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে বোঝা যায়, সবার মধ্যেই এক ধরনের অস্থিরতা আছে।
সরকার ও সরকারি দলের মধ্যে যেমন অস্থিরতা আছে, তেমনি সরকারবিরোধীদের মধ্যেও আছে। অস্থিরতা-অস্বস্তি আছে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও। সরকার যেমন ক্ষমতায় থাকার উপায়-কৌশল নিয়ে ভাবছে, তেমনি সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মরিয়া। সাধারণ মানুষের মূল ভাবনা, যেভাবে ব্যয় বাড়ছে আর আয় কমছে, তাতে টিকে থাকা যাবে তো? অবশ্য রাজনৈতিক মহলে এমন মতই এখন পর্যন্ত প্রবল যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে টেক্কা দেওয়ার মতো রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক শক্তি বিএনপি এখনো অর্জন করতে পারেনি। তাই আগামী নির্বাচনেও জয় পাবে আওয়ামী লীগই।
কিন্তু আসন্ন নির্বাচন যে আগের দুটি নির্বাচনের মতো হবে না- এটা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই একাধিক বার বলেছেন। আগামী নির্বাচন কঠিন হবে বলেই তিনি উল্লেখ করেছেন। ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাপ্রত্যাশী- উভয়পক্ষের জন্যই আগামী নির্বাচন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রশ্ন হলো ওই ‘কঠিন নির্বাচন’ বা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো কতটুকু প্রস্তুত?
আওয়ামী লীগের পায়ের নিচের মাটি নরম করে দেওয়ার চেষ্টা দেশের ভেতরে-বাইরে সমানে চলছে। বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে যারা বাধা তৈরি করবে, তাদের জন্য বিধিনিষেধ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে গত ২৪ মে। এ নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়।
এই ঘটনাপ্রবাহে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টির ছয়জন, পরে ডেমোক্রেটিক পার্টির ছয়জন কংগ্রেসম্যান পৃথকভাবে চিঠি দেন দেশটির সরকারের কাছে। তারা বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা এবং মানবাধিকার ও সংখ্যালঘুদের অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ইউরোপীয় পার্লামেন্টেরও ছয়জন সদস্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেলকে একটি চিঠি লেখেন। তাদেরও চিঠির বিষয় একই রকম।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মহলের এসব উদ্বেগ এবং পদক্ষেপে আওয়ামী লীগ সরকারকে কি খুব বেশি বিচলিত মনে হচ্ছে? আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রীদের কেউ কেউ কিছু অসংলগ্ন মন্তব্য করলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে বলছেন যে, বাইরের কারও চাপের কাছে মাথা নত করবেন না। তবে পরিস্থিতিটা যেন উদ্বেগজনক হয়ে না ওঠে সে জন্য সরকারের প্রস্তুতি আছে বলেই মনে হয়।
অনেকের মনে প্রশ্ন, আগের দুই নির্বাচনের মতো আগামী নির্বাচনেও ভারতই কি হবে আওয়ামী লীগের ভরসাস্থল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অবশ্য বলেছেন, আওয়ামী লীগ বাইরের কারও ওপর নয়, দেশের জনগণের ওপর ভরসা করেই রাজনীতি করে। তবে সম্প্রতি ভারতের উত্তর প্রদেশের বারানসিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। সেখানে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে তার একান্ত বৈঠক হয়। নির্বাচন, মার্কিন নতুন ভিসানীতি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও যুক্তরাষ্ট্রের ‘চাপ’ নিয়ে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে বিস্তারিত কথা হয়।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানের সঙ্গে গত সপ্তাহে নয়াদিল্লিতে বৈঠক করেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। ওই বৈঠকে তাকে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের এমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া ঠিক হবে না, যাতে ভারতের স্বার্থ বিনষ্ট হয় ও আঞ্চলিক ভারসাম্য নষ্ট হয়।
ভারতের এই স্পষ্ট অভিমত বাংলাদেশকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে দুই দেশের কূটনৈতিক মহলের খবর। এরও আগে জয়শঙ্করের সঙ্গে দিল্লিতে বৈঠক করেছিলেন ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মুস্তাফিজুর রহমান। সেই বৈঠকেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নতুন ভিসানীতি এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও স্থিতিশীলতা নিয়ে আলোচিত হয়েছিল।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আগামী ২১ জুন সরকারি সফরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন। পরের দিন হোয়াইট হাউজে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভ্যর্থনা জানাবেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। দুই নেতার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনাও ওই দিনই। এই সফরে বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সক্রিয়তা’ নিয়ে আলোচনার সম্ভাবনা কতখানি, সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ভারত সরকারের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে প্রতিটি বৈঠকেই প্রধানমন্ত্রী মোদী প্রতিবেশীদের নিয়ে আলোচনা করেন। প্রতিবেশীদের নিয়ে দুই নেতারই আগ্রহ যথেষ্ট।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এক কথায় চমৎকার। এই অবস্থায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারত কীভাবে এবং কতটুকু প্রভাব বিস্তার করবে, দেখার বিষয় সেটাই। ভারতের পক্ষ থেকে কিছুদিন আগে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষ কাকে ভোট দেবেন, কোন দলকে সমর্থন করবেন, তা তাদের বিষয়।
এ বিষয়ে ভারত অনধিকার চর্চা করে না, করবেও না। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে বলে ভারত সেই সব ঘটনা থেকে চোখ ফিরিয়েও থাকতে পারে না। আঞ্চলিক ও ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ভারত তাই স্বাভাবিক কারণেই আগ্রহী। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে অতীতে ভারতের সক্রিয়তা প্রকাশ্যেই দেখা গেছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, মোদীর কথায় কি বাইডেন মনস্থির বা মন পরিবর্তন করবেন? এটা ঠিক যে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা ও সুস্থিতির প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র যতটা উদ্বিগ্ন, ভারতও ততটাই এবং এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুরুত্ব অসীম। সেই গুরুত্ব অনুধাবন করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সম্প্রতি এই বিষয়ে বাংলাদেশের নীতি ঘোষণা করেছেন।
ওয়াকিবহাল মহলের মতে, সংগত কারণেই প্রধানমন্ত্রী মোদী যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাবেন আঞ্চলিক স্বার্থে শেখ হাসিনার ক্ষমতাসীন থাকার গুরুত্ব কী। তার ক্ষমতাসীন থাকা না-থাকার ওপর আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির মাথাচাড়া দেওয়া না-দেওয়ার প্রশ্নটি যে গভীর সম্পর্কযুক্ত, সে কথা বাইডেনকে মোদি জানাবেন, এটাই স্বাভাবিক।
অন্যদিকে আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের টানাপোড়েন লক্ষ্য করেই সম্ভবত চীন শেখ হাসিনার পক্ষে থাকার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে কারও কারও নজর কেড়েছে। চীনের বিষয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একইভাবে চিন্তিত। বাংলাদেশের ওপর চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব যথেষ্ট। যদিও রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। সেই ভারসাম্য কিংবা আঞ্চলিক সুস্থিতি নষ্ট হোক- এটা ভারতেরও যেমন কাম্য নয়, তেমনি আমেরিকাও সেটা চায় না। চীনের দিকে বাংলাদেশের বেশি মাত্রায় ঝুঁকে পড়া যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত কারও পক্ষে মঙ্গলজনক নয়, সেটা মোদি বুঝলে বাইডেন বুঝবেন না কেন?
কূটনৈতিকভাবে বাইরের বিষয়গুলো সামলে নেওয়ার চেষ্টা যখন চলছে, তখন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-মন্ত্রীদের সমন্বয়হীন এবং অতিকথনও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা তৈরি করছে। ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতারাও এ নিয়ে বিরক্ত। জোটের একাধিক সভায় তাদের এ বিষয়ে কঠোর সমালোচনা করতে দেখা গেছে। পাশাপাশি নেতা-মন্ত্রীদের আরও বেশি সতর্ক হয়ে কথাবার্তা বলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বাছ-বিচার ছাড়াই মন্ত্রীদের স্ববিরোধী বক্তব্য নির্বাচনের আগে সরকারকে বেকায়দায় ফেলবে। বিরোধী শক্তিগুলো এ সুযোগ নিয়ে সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে, যা আওয়ামী লীগ কিংবা ১৪ দলের জন্য সুখকর হবে না। ৪ জুন রাজধানীর ইস্কাটনে ১৪ দলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকেও বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি কয়েকজন মন্ত্রীর অতিকথন নিয়েও কঠোর সমালোচনা করা হয়।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুৎ সংকট, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ডলার বাজারের অস্থিরতাসহ নানা বিষয় নিয়ে এমনিতেই চাপের মধ্যে রয়েছে সরকার। এরমধ্যে নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহলের নানামুখী তৎপরতার মুখে সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা যেন কথাবার্তা না বলেন, সেদিকে সরকারপ্রধানের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
নতুন করে সামনে আসা জামায়াতে ইসলামীর ইস্যু নিয়েও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করছেন। ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে’ জামায়াতকে ঢাকায় সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে-এমন মন্তব্য করেছেন মন্ত্রিপরিষদের এক সিনিয়র সদস্য। একইদিন আরেক মন্ত্রী জানিয়েছেন-সমাবেশের অনুমতি দিলেও জামায়াতে ইসলামীর বিষয়ে আওয়ামী লীগের নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি।
এছাড়া মন্ত্রিপরিষদের আরও দুজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য প্রায় একই ধরনের বক্তব্য দিয়ে বলেছেন, জামায়াত এখনো যেহেতু নিষিদ্ধ নয়, সেজন্য তাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে এবং চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত জামায়াতকে দোষী বলা যাবে না। মন্ত্রী-নেতাদের এমন সমন্বয়হীন কথাবার্তায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মীও হতাশ। তারা মনে করছেন, অহেতুক সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা করার অস্ত্র তুলে দেওয়া হচ্ছে বিরোধী পক্ষকে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নেতা-মন্ত্রীদের কথা বলার আগে চিন্তা-ভাবনা করেই বলা উচিত।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী পরাজিত হওয়ায় দলের নেতাকর্মী-সমর্থকদের মধ্যে অনেক প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, উদ্বেগও বেড়েছিল। তারপর অবশ্য বরিশাল ও খুলনায় নৌকা জয় পেয়েছে। ওই দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়ী হওয়ায় আওয়ামী লীগের মনোবল ফিরেছে। সিলেট ও রাজশাহীতেও নৌকাই জয়ী হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এই সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো থেকে আওয়ামী লীগ নিজেদের ত্রুটি-দুর্বলতা নিয়ে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করবে কি না সেটাই এখন দেখার বিষয়। আওয়ামী লীগ যদি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভালো প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারে, যদি দলের মধ্যে ঐক্য বজায় থাকে, বিশ্বাসঘাতকদের উৎপাত যদি বন্ধ করতে পারে, তাহলে অসংগঠিত ও নানামতে বিভক্ত বিরোধীদের উৎসাহের বেলুন ফুটো হতে সময় লাগবে। আওয়ামী লীগের হাল ধরার পর শেখ হাসিনা অনেক সংকটময় মুহূর্তে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিয়ে তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। অভিজ্ঞতা তাকে এখন আরো পরিপক্ব করেছে। তাই এবারও তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হবেন যে দেশের রাজনীতি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি।
লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর।