সেভেন সিস্টার খ্যাত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে অর্ধশতাধিক পণ্য রপ্তানি হয়ে আসছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে। সেখানে বাংলাদেশি এসব পণ্যের ব্যাপক চাহিদাও ছিল। কিন্তু এখন রপ্তানি হচ্ছে হিমায়িত মাছসহ হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি পণ্য। ফলে কমেছে আমদানি বাণিজ্যও।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, অন্য স্থলবন্দর দিয়ে সুবিধা বেশি পাওয়ায় এ বন্দর দিয়ে মাছ রপ্তানিও অর্ধেকের নিচে নেমেছে। পাশাপাশি ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার সঙ্গে পুরো ভারতের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় তারা এখন অধিকাংশ পণ্য নিজ দেশেই পেয়ে যাচ্ছেন। এর প্রভাব পড়েছে আখাউড়া স্থলবন্দরে।
জানা গেছে, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ৩০৪ কোটি টাকা রপ্তানি আয় কম হয়েছে৷ এছাড়া তলানিতে ঠেকেছে বন্দরের আমদানি বাণিজ্যও।
এক সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে অর্ধশতাধিক পণ্য ভারতে রপ্তানি হলেও এখন রপ্তানি হচ্ছে হাতেগোনা কয়েকটি পণ্য। মূলত এখন হিমায়িত মাছের ওপরই অনেকাংশ নির্ভর করে বন্দরের রপ্তানি বাণিজ্য। তবে মাছ রপ্তানি কমার কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়েছে ৩৭৬ কোটি ২৩ লাখ টাকার পণ্য, যা এর আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩০৪ কোটি টাকা কম। এছাড়া তলানিতে ঠেকেছে বন্দরের আমদানি বাণিজ্যও। ফলে আশানুরূপ রাজস্ব পাচ্ছে না বন্দর এবং শুল্ক স্টেশন কর্তৃপক্ষ।
স্থলবন্দরের ব্যবসায়ীরা জানান, এতদিন আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়ে আসছিল হিমায়িত মাছ, পাথর, রড, সিমেন্ট, তুলা, ভোজ্য তেল, এলপি গ্যাস, প্লাস্টিক, শুঁটকি ও বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রীসহ অর্ধশতাধিক পণ্য। বর্তমানে হিমায়িত মাছ, রড, সিমেন্ট ও প্লাস্টিকসহ হাতে গোনা কয়েকটি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। এরমধ্যে প্রধান রপ্তানিপণ্য হচ্ছে মাছ। এই মাছ রপ্তানিও অর্ধেকের নিচে নেমেছে। আগে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ টন মাছ রপ্তানি হলেও এখন তা কমে ২৫ থেকে ৩০ টনে দাঁড়িয়েছে। এখন প্রতিদিন (ছুটির দিন ব্যতীত) ভারতে গড়ে এক থেকে দেড় লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হচ্ছে।
এই রপ্তানি কমার কারণ জানতে চাইলে স্থলবন্দরের মাছ রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. ফারুক মিয়া বলেন, ভারত-বাংলাদেশের আখাউড়া সীমান্তের কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে তাজা মাছ অবৈধভাবে পাচার হচ্ছে। অবৈধভাবে নিতে পারলে কেন বন্দর দিয়ে নেবে? এর ফলে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা হিমায়িত মাছের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। বিষয়টি বিজিবি, বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। মাছ চোরাচালান বন্ধ করতে হবে। নাহলে যেকোনো সময় হিমায়িত মাছের রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে।
রপ্তানির পাশাপাশি আমদানি বাণিজ্যেও এই স্থলবন্দরে ধস নেমেছে। সদ্য বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে বন্দর দিয়ে ভারত থেকে আমদানি হয়েছে শুধু গম, ভুট্টা, পাথর ও পেঁয়াজ। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ভারত থেকে আমদানি হয়েছে মাত্র ৬৫ কোটি ৯৩ লাখ ৬১ হাজার ৫২৮ টাকার পণ্য। আমদানি পণ্য থেকে শুল্ক কর্তৃপক্ষ রাজস্ব পেয়েছে ৫৫ লাখ ৭৮ হাজার ৬৯৮ টাকা। কিন্তু এর আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ২৮৮ কোটি ৪১ লাখ ১৩ হাজার ৪৬৮ টাকার পণ্য।
আমদানি-রপ্তানি কমার কারণ হিসেবে স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফোরকান আহমেদ খলিফা বলেন, আমাদের রপ্তানি পণ্য হিসেবে মাছ ছিল বেসিক। শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিনই মাছ রপ্তানি হতো। এছাড়াও ছিল পাথর। সিলেট দিয়ে ভারত থেকে পাথর এসে আখাউড়া দিয়ে আবার সেভেন সিস্টার খ্যাত অঞ্চলে যেত। কিন্তু ভারতের আগরতলায় রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় তারা নিজ দেশে রেলের মাধ্যমেই পাথর পরিবহন করছে। এক ট্রেনেই ২৬টি বগির র্যাকে বিপুল পরিমাণ পাথর আনতে পারে। ফলে আখাউড়া স্থলবন্দরে দিয়ে পাথর পরিবহন বন্ধ করে দেওয়ায় এই খাতে রাজস্বও বন্ধ হয়ে গেছে। আর মাছও এই বন্দর দিয়ে রপ্তানি অর্ধেকে নেমেছে। কারণ সিলেটের চাতলাপুর বন্দর দিয়ে ১০-১২ ট্রাক মাছ রপ্তানি করে, কাগজে যার ২-৩টির রাজস্ব দিলেই চলে। আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে একটাও রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই। তাই ওই বন্দর দিয়ে বেশি মাছ রপ্তানি হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা চাই এই বন্দর দিয়ে নিষিদ্ধ পণ্য বাদে সব ধরনের পণ্য আমদানি-রপ্তানির সুযোগ দেওয়া হোক। এতে বন্দরের রাজস্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসবে।
তিনি বলেন, রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আখাউড়া স্থলবন্দরে এলে এই দাবি তুলেছিলাম। কিন্তু তিনি বলেছিলেন প্রাথমিকভাবে সুনির্দিষ্ট কিছু পণ্যের তালিকা যেন আমরা দেই। আমরা সেই অনুযায়ী স্থানীয় এমপি আইনমন্ত্রীর ডিওসহ তালিকা রাজস্ব বোর্ডে জমা দিয়েছি। কিন্তু তা এখানো বাস্তবায়ন হয়নি।
আখাউড়া স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম বলেন, আখাউড়া স্থলবন্দরে আমদানি নেই, আর রপ্তানি খুবই কম হচ্ছে। রপ্তানি হচ্ছে শুধু মাছ। তাও অনেক কম। এই বন্দর দিয়ে যেসব পণ্য আমদানির অনুমোদন আছে, তা কোনো ব্যবসায়ী আনতে চান না। আমরা নতুন ৭টি পণ্য আমদানি করতে রাজস্ব বোর্ডে তালিকা দিয়েছি। এরমধ্যে গমের ভূসি, মোটর পার্স, শাড়ি, থ্রি-পিস ও পাঞ্জাবি রয়েছে। আপাতত এসব পণ্য আমদানির সুযোগ দিলে আখাউড়া স্থলবন্দরে ব্যবসা বাণিজ্য কিছুটা বাড়বে।
আখাউড়া স্থলবন্দরের সহকারী পরিচালক মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, স্থলবন্দরে রাজস্ব আয়ের বিষয়টি অনেকাংশেই আমদানি বাণিজ্যের ওপর নির্ভর করে। এক্ষেত্রে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি অনিয়মিত হওয়ায় রাজস্ব আদায় কম হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা যেসব পণ্য আমদানির জন্য তালিকা দিয়েছেন তা নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা ও চিঠি চালাচালি হচ্ছে।
১৯৯৪ সালে সর্বপ্রথম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পণ্য রপ্তানি কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথমে স্থল শুল্ক স্টেশন দিয়ে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য চললেও ২০০৮ সালে পূর্ণাঙ্গ বন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় আখাউড়া স্থলবন্দর। মূলত এ বন্দর দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে পণ্য রপ্তানি হয়।