নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর ৭ খুনের দায়ে প্রধান চার আসামিসহ ১৫ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়েছে।
সোমবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে এই রায় প্রকাশ করা হয়।
গত বছরের ২২ আগস্ট দেওয়া যেই রায়ে বিচারিক আদালতের মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া ২৬ আসামির মধ্যে বাকি ১১ জনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
এ মামলার মোট ৩৫ আসামির মধ্যে বাকি ৯ জনের বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডও বহাল রাখেন হাইকোর্ট। মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা আসামিরা হচ্ছেন- নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের (নাসিক) সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন এবং র্যাব-১১ এর চাকরিচ্যুত তিন কর্মকর্তা সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মুহাম্মদ, মেজর (অব.) আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার (অব.) মাসুদ রানা।
আরও ফাঁসির আদেশ বহাল ১১ আসামি হলেন, র্যাবের চাকরিচ্যুত সাবেক হাবিলদার মো. এমদাদুল হক, ল্যান্সনায়েক হীরা মিয়া, আরওজি-১ এ বি মো. আরিফ হোসেন, ল্যান্সনায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহী আবু তৈয়্যব আলী, কনস্টেবল শিহাব উদ্দিন, এসআই পূর্ণেন্দু বালা, সৈনিক আবদুল আলীম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, সৈনিক আলামিন শরীফ ও সৈনিক তাজুল ইসলাম। তাদের মধ্যে মহিউদ্দিন মুন্সী, আলামিন শরীফ ও তাজুল ইসলাম পলাতক।
অন্যদিকে সাজা কমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ১১ আসামি হচ্ছেন- র্যাবের চাকরিচ্যুত সাবেক সিপাহি আসাদুজ্জামান নূর ও সার্জেন্ট এনামুল কবির এবং নূর হোসেনের ৯ সহযোগী মূর্তজা জামান চার্চিল, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দিপু, আবুল বাশার, রহম আলী, জামাল উদ্দিন সরদার, ভারতে গ্রেফতার সেলিম, সানাউল্লাহ সানা ও শাহজাহান। তাদের মধ্যে সেলিম, সানাউল্লাহ সানা ও শাহজাহান পলাতক।
বিচারিক আদালতে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড পাওয়া ৯ জনও র্যাবের বরখাস্তকৃত কর্মকর্তা ও সদস্য।
তাদের মধ্যে কনস্টেবল (পরে এএসআই পদে পদোন্নতি পেয়ে নৌ-থানায় কর্মরত) হাবিবুর রহমানের ১৭ বছর, এএসআই আবুল কালাম আজাদ, এএসআই কামাল হোসেন, কনস্টেবল বাবুল হাসান, কর্পোরাল মোখলেসুর রহমান, ল্যান্স কর্পোরাল রুহুল আমিন ও সিপাহী নুরুজ্জামানের ১০ বছর করে এবং এএসআই বজলুর রহমান ও হাবিলদার নাসির উদ্দিন ৭ বছর করে কারাদণ্ডাদেশ বহাল রয়েছে উচ্চ আদালতে। তাদের মধ্যে মোখলেসুর রহমান ও কামাল হোসেন পলাতক। সব মিলিয়ে দণ্ডপ্রাপ্ত ৩৫ জনের মধ্যে কারাগারে আছেন ২৭ জন আর পলাতক ৮ জন।
২০১৭ সালের ২২ আগস্ট বিকেলে সাত খুনের দুই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের এ রায় দেন বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
২৬ জনের মধ্যে গ্রেফতার ও আত্মসমর্পণ করে কারাগারে থাকা ২০ জন নিয়মিত ও জেল আপিল করেন। পলাতক অন্য ৬ আসামি আপিল করেননি। আপিলগুলোর আংশিক মঞ্জুর করেছেন হাইকোর্ট।
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার লামাপাড়া এলাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ ৭ জনকে অপহরণের তিনদিন পর তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
ওই ঘটনায় নিহত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ২নং ওয়ার্ডের তৎকালীন কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র-২ নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, নজরুলের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিম।
সাত খুনের ঘটনায় প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও তার ৪ সহকর্মী হত্যার ঘটনায় তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বাদী হয়ে ফতুল্লা থানায় একটি এবং সিনিয়র আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়ির চালক ইব্রাহিম হত্যার ঘটনায় জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে একই থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করেন।
দু’টি মামলার বিচারিক কার্যক্রম একসঙ্গে শেষ করে গত ১৬ জানুয়ারি নূর হোসেন ও র্যাবের বরখাস্তকৃত তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেনের আদালত। ৩৫ জন আসামির বাকি ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
এরপর হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখা থেকে মামলার সব নথি বিজি প্রেসে পাঠানো হয়। বিজি প্রেস পেপারবুক প্রস্তুত করে গত বছরের ৭ মে হাইকোর্টে পাঠায়।
একই বছরের ২২ মে থেকে আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শুরু হয়। ৩৩ কার্যদিবসে উভয়পক্ষের শুনানি হয়।
রায় প্রকাশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, নিম্ন আদালতে যাদের ফাঁসি হয়েছে, আমাদের হাই কোর্ট ডিভিশনে থে রেফারেন্স কেসেও সেগুলো বহাল আছে এবং নিম্ন আদালতে ফাঁসির আদেশ দিলেই সেটা কার্যকর হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত হাই কোর্ট সেটা কনফার্ম না করে। এই কনফার্মেশনই হয় ডেথ রেফারেন্সের (কেস) মামলায়। এখন ডেথ রেফারেন্স কেস আসামিরা যারা আপিল ফাইল করেছে, সে আপিলগুলো সব একত্রে শুনানি হয়েছে। একত্রে শুনানি হয়ে অধিকাংশ আপিলকারীর আপিলগুলো ডিসমিশ হয়েছে ও নিম্ন আদালতে যাদের ফাঁসির আদেশ ছিল সেটা বহাল আছে। এখন এই আদেশের বিরুদ্ধে তারা যদি মনে করেন আপিল করবেন তারা আপিল বিভাগে আপিল করবেন। সংবিধানের বিধান অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির ফাঁসি বা যাবজ্জীবন হলে তিনি যদি আপিল বিভাগে আপিল করেন এজএ মেটার অব লাইফ শুনানির অধিকার তার আছে। সুতরাং আপিল ফাইল করলেই আপিল হিসেবে ট্রিট করা হবে এবং শুনানি হবে।