প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র সলোমন দ্বীপপুঞ্জ। আদতে ছোট ছোট অসংখ্য দ্বীপের সমন্বয়ে এই রাষ্ট্র গঠিত। দেশটির সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে ‘স্বাধীনতার সঙ্গে আপস করার’ অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, চীনের সংবাদ সংস্থার সঙ্গে আপসকামী চুক্তি সই করেছে সলোমন দ্বীপপুঞ্জের কয়েকটি সংবাদমাধ্যম। সেই সঙ্গে সলোমন দ্বীপপুঞ্জের চীনা দূতাবাসের মাধ্যমে হাজার হাজার ডলারের উপহার ও উপকরণ নেওয়া হয়েছে। খবর গার্ডিয়ানের।
গত বছরের মার্চে সলোমন দ্বীপপুঞ্জের সরকার চীনের সঙ্গে একটি উচ্চপর্যায়ের নিরাপত্তা চুক্তি সই করে। এরপর থেকে দ্বীপরাষ্ট্রটির কয়েকটি সংবাদপত্র ও সাংবাদিকেরা চীনের কাছ থেকে হাজার হাজার ডলারের নানা উপহার পেয়েছেন। এ তালিকায় ফোন, ক্যামেরা, প্রিন্টিং যন্ত্রাংশ, ড্রোন ও গাড়ি রয়েছে। সলোমন স্টার— দ্বীপরাষ্ট্রটির পাঠকপ্রিয় একটি সংবাদপত্র। চীন সরকারের কাছ থেকে সংবাদপত্রটি ১ লাখ ৪০ হাজার ডলারের তহবিল পেয়েছে। এর বিপরীতে সংবাদপত্রটির পক্ষ থেকে সলোমন দ্বীপপুঞ্জে ‘চীনের উদারতা এবং দেশটির উন্নয়নে চীনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রকৃত সত্য প্রচারের’ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
সলোমন দ্বীপপুঞ্জের কয়েকজন সাংবাদিক এসব ঘটনায় নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, উপহার দেওয়ার পাশাপাশি চীনের সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে তাদের দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এগিয়ে নিচ্ছে, সংলাপ করছে। এটা নিয়েও তাদের উদ্বেগ রয়েছে। তহবিল পাওয়ার জন্য সলোমন স্টারের কর্তৃপক্ষ চীনা দূতাবাসে একটি প্রস্তাবনা পাঠিয়েছিল। সেটার একটি কপি ওসিসিআরপির হাতে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, সলোমন স্টারের ছাপাখানার যন্ত্রপাতি বেশ পুরোনো ও জরাজীর্ণ। এ কারণে সংবাদপত্রটি ছাপাতে বিলম্ব হয়। এর ফলে সলোমন দ্বীপপুঞ্জের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে চীনের ভূমিকার খবর প্রচার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রস্তাবনায় সলোমন স্টারের প্রধান সম্পাদক অব্রে বেলফোর্ড বলেছেন, চীনের গল্পগুলো ইতিবাচক উপায়ে প্রকাশ ও প্রচারের জন্য এই অর্থায়ন জরুরি। গত মঙ্গলবার সংবাদপত্রটিতে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করা হয়েছে। এতে চীনের পক্ষ থেকে তহবিল পাওয়ার কথা স্বীকার করেছে পত্রিকাটি। বলা হয়েছে, এখানে লুকানোর কিছু নেই। তবে সংবাদপত্রটি জানিয়েছে, চীনের পক্ষ নিয়ে বা চীনের স্বার্থ রক্ষা করে তারা কোনো সংবাদ প্রকাশ বা প্রচার করেনি। আরও বলা হয়েছে, সলোমন স্টার কর্তৃপক্ষ অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও তহবিল সহায়তা চেয়েছিল, কিন্তু যথাযথ সাড়া পাওয়া যায়নি। তাই সংবাদপত্রের জন্য মুদ্রণের সরঞ্জাম ও একই প্রতিষ্ঠানের একটি রেডিও স্টেশনের জন্য সম্প্রচার টাওয়ার বানাতে চীনের কাছে অর্থ চাওয়া হয়।
সলোমন স্টারে কর্মরত একজন সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য গার্ডিয়ানের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, উপকরণ আর যন্ত্রাংশের নামে চীন সরকার ও চীনা সংবাদমাধ্যমের অংশীদারদের কাছে থেকে সহায়তা সলোমন দ্বীপপুঞ্জে এসেছে। সংবাদমাধ্যমগুলো গাড়ি, ক্যামেরা, আইফোন, ল্যাপটপ, ড্রোন পেয়েছে। ২০২২ সালের ৮ এপ্রিল চীনা দূতাবাসের পক্ষ থেকে দুই ঘণ্টার একটি বৈঠক আয়োজন করা হয়। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘জুমে’ এই বৈঠক হয়। বৈঠকে সলোমন দ্বীপপুঞ্জের সংবাদমাধ্যমের কর্মকর্তা–সাংবাদিকেরা চীনের গুয়াংদং প্রদেশের সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক পোক্ত করা এই বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল।
ওই সাংবাদিক আরও বলেন, সলোমন দ্বীপপুঞ্জের সাংবাদিকদের একটি দল চীনা দূতাবাসের সঙ্গে বৈঠক করেছে। আমাদের (সলোমন স্টার) সম্পাদক সেই বৈঠকে ছিলেন। এরপর দূতাবাসের পক্ষ থেকে এসব উপহার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। উপহারের বিনিময়ে আমাদের চীন–সংক্রান্ত সংবাদ প্রচারের সময় আরেকটু বেশি সংবেদনশীল হতে বলা হয়েছিল।
সলোমন দ্বীপপুঞ্জের আরেকটি পাঠকপ্রিয় সংবাদপত্র আইল্যান্ড সান। সংবাদপত্রটির সাবেক সম্পাদক ওফানি এরেমায়ে জানান, ২০২১ সালের আগস্টে চীনা দূতাবাস সংবাদপত্রটিকে কম্পিউটার উপহার দেয়। তখন আইল্যান্ড সান কর্তৃপক্ষ জানায়, করোনা মহামারির সময় তথ্য প্রচারে তা ব্যবহার করা হয়েছে। পরবর্তী সময় এই সংবাদপত্র চীনের কাছ থেকে অন্যান্য উপহার ও উপকরণ পেয়েছে।
নিরাপত্তা চুক্তি সই হওয়ার পর থেকে চীনের সঙ্গে সলোমন দ্বীপপুঞ্জের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আলাদা নজরে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে, পশ্চিমা দেশগুলো ও পশ্চিমা বিশ্লেষকদের অনেকেই আশঙ্কা করছেন, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ ক্রমেই প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব বিস্তারের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে উঠছে। এটা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে পশ্চিমাদের।
সামগ্রিক বিষয়ে মন্তব্য জানতে গার্ডিয়ানের পক্ষ থেকে সলোমন স্টার, আইল্যান্ড সান ও দ্বীপরাষ্ট্রটির চীনা দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল, তবে সাড়া পাওয়া যায়নি। অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্স বিভাগের জ্যেষ্ঠ ফেলো গ্রায়েম স্মিথ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, চীনের সংবাদমাধ্যম আর সলোমন দ্বীপপুঞ্জের সংবাদমাধ্যমের এমন সম্পর্ক স্বাধীনতার সঙ্গে আপসের কারণ হতে পারে।