শিল্প সংস্কৃতির রাজধানী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদীতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বাঙালির ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা। ধর্মের নামে অধর্ম চর্চাকারী ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বাধার মুখে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটিতে হারাতে বসেছিল বাঙালির প্রাণের এই উৎসব। এই উৎসবটি ১৯৭৫ সালের পর উগ্রবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর বাধায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থা বিরাজ করে দীর্ঘ ৩৫ বছর।
২০১১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে সংস্কৃতি বান্ধব সংসদ সদস্য যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী প্রথম বার এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর তিতাসের বুকে পুনরায় প্রাণ ফিরে আসে। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে চালু করা হয় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা। এরপর থেকে অদ্যাবধি ধারাবাহিকভাবে এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করে যাচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসন। তবে মধ্যে দুই বছর (২০২০ ও ২০২১) করোনা মহামারির কারণে প্রতিযোগিতার আয়োজন বন্ধ ছিল।
এবছর ইউনিভার্সিটি অব ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিঃ, দারাজ বাংলাদেশ ও ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ-এর সহযোগিতায় তিতাস নদীতে ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জেলা প্রশাসন।
তিতাসের বুকভরা ঢেউ আর প্রাণভরা উচ্ছাসে পৌর এলাকার শিমরাইলকান্দি গাঁওগ্রাম এলাকা থেকে মেড্ডার শিশু পরিবার এলাকায় তিতাস নদীতে অনুষ্ঠিত হয় এই নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা।
এবছর, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ১৫টি নৌকা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার ৫ টি নৌকা, সরাইল উপজেলার ১টি নৌকা, আশুগঞ্জ উপজেলার ২টি নৌকা (হবিগঞ্জ থেকে ভাড়া), নবীনগর থেকে ২টি নৌকা (হবিগঞ্জ থেকে ভাড়া), নাসিরনগর উপজেলার ১ টি নৌকা (হবিগঞ্জ থেকে ভাড়া) ও সদর উপজেলার ৪ টি নৌকা (হবিগঞ্জ থেকে ভাড়া)। নৌকা বাইচ চলার সময় তিতাস নদী (শিমরাইলকান্দি গাঁওগ্রাম পয়েন্ট থেকে মেড্ডা সরকারি শিশু পরিবার পয়েন্ট পর্যন্ত) এলাকায় পুলিশ, বিজিবি, আনসার ও নৌ-পুলিশের কয়েকটি টীম নিয়োজিত ছিল। এছাড়াও ছিল ডুবুরী দল, ফায়ার সার্ভিস ও মেডিকেল টিম। পাশাপাশি নৌকা বাইচ সুশৃখলের জন্য জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ৮টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়।
বিকেল ৩টার দিকে পৌর এলাকার শিমরাইলকান্দি গাঁওগ্রাম এলাকায় নৌকা বাইচের উদ্বোধন করা হয়।
বিকেল ৫ টার দিকে মেড্ডার কালাগাজীর মাজার এলাকায় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতায় বিজয়দের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে পুরস্কার বিতরণ করেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর-বিজয়নগর) আসনের সংসদ সদস্য যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী।
মোকতাদির চৌধুরী বলেন, যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, যতদিন বাঙালি থাকবে, যতদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটিতে বাঙালির সংস্কৃতি চর্চা করার সুযোগ থাকবে তত দিন এখান থেকে নৌকা বাইচকে কেউ উচ্ছেদ করতে পারবে না। ৩৫ বছর পর এই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২০১১ সালে আমি সংসদ সদস্য হওয়ার পরে নৌকা বাইচ আয়োজনের সাহস করেছিলাম। এখন পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে।
তিনি বলেন, নৌকা বাইচ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষের অন্যতম উৎসব। তিতাসের পাড়ে আজ লাখো মানুষের ঢল। এতেই বুঝা যায় মানুষ নৌকা বাইচ কতো ভালোবাসে। এখানে যারা ধর্ম ব্যবসা করে এবং ধর্মের নাম ব্যবহার করে একটি চমৎকার উৎসবকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়, তাদের এসমস্ত হীন প্রচেষ্টাকে আমি তীব্রভাবে নিন্দা জানাই। এসময় অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত সবাইকে ধন্যবাদ জানান মোকতাদির চৌধুরী এমপি।
জেলা প্রশাসক মোঃ শাহগীর আলমের সভাপতিত্বে অতিথি ছিলেন বিশেষ অতিথি ছিলেন পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাখাওয়াত হোসেন, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আল মামুন সরকার, পৌর মেয়র মিসেস নায়ার কবির, প্রেসক্লাবের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জসীম উদ্দিন।
জেলা প্রশাসক মো. শাহগীর আলম বলেন, করোনার কারণ গত দুই বছর ২০২০ ও ২০২১ নৌকা বাইচ বন্ধ ছিলো। করোনার পর ২০২২ সালে আবার নৌকা বাইচ হয়। গতবার থেকে এবার নৌকা বাইচ আরো বেশি সৌন্দর্য ও চাকচিক্য বাড়ানোর চেষ্টা করেছি। আগামীতেও এই নৌকা বাইচ অব্যাহত থাকবে।
প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়া নবীনগর উপজেলাকে (হবিগঞ্জের লামা পাইল যুব সংঘের নৌকা) ১ লাখ টাকা, দ্বিতীয় হওয়া সরাইল উপজেলা (শাহবাজপুরের বাবুল মোল্লার নৌকা) ৫০ হাজার ও তৃতীয় হওয়া সদর উপজেলা (হবিগঞ্জের শাহাজালালের তরী) ৩০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হয়। এছাড়া নৌকা বাইচে অংশ নেয়া ১৫ টি নৌকাকেই ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়।
এদিকে নৌকা বাইচ প্রতিযোগীতা উপভোগ করতে দুপুর থেকেই জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও আশপাশ এলাকা থেকে হাজার-হাজার মানুষ তিতাসের দু’পাড়ে, বিভিন্ন ভবনের ছাদের উপর ভীড় জমায়। অনেকেই নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা উপভোগ করতে ছোট ছোট নৌকা ভাড়া করে পরিবার পরিজন নিয়ে তিতাস নদীর বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়।
নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা চলার সময় শিমরাইলকান্দি গাঁওগ্রাম এলাকা থেকে মেড্ডা শিশু পরিবার এলাকা পর্যন্ত নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটের নেতৃত্বে ১০টি মোবাইল কোর্ট টিমসহ বিপুল সংখ্যক পুলিশ, আনসার ফায়ার সার্ভিস, বিএনসিসি, নৌ-পুলিশ, ডুবুরীদল, ফায়ার সার্ভিস ও মেডিকেল টিম কয়েকটি টীম নিয়োজিত ছিল। এছাড়াও ছিল ডুবুরীদল, ফায়ার সার্ভিস ও মেডিকেল টীম। নিরাপত্তার জন্য আকাশে উড়ানো হয় ড্রোন।