চিরায়ত কল্যাণী শেখ রেহানা

এম নজরুল ইসলাম

শেখ রেহানা। ফাইল ছবি

মঞ্চে পাদপ্রদীপের আলো যেখানে পড়ে সে জায়গাটি জ্বলজ্বল করে। উইংসের পাশে সেই অর্থে আলো না থাকলেও সেখানে এমন কেউ কেউ থাকেন, যাঁদের আলোয় মঞ্চ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সাদা চোখে সে আলোর বিচ্ছুরণ দেখা যায় না, অনুভব করা যায়। তেমনই একজন মানুষ শেখ রেহানা। তাঁকে স্পর্শ করেনি কোনো মোহ। যেন এক অন্তর্গত মানুষ হিসেবেই নিজেকে গড়ে তুলেছেন তিনি। নিজের বড় বোন দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা, চারবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু শেখ রেহানা এক আশ্চর্য শক্তিবলে এই পরিচয়ের গণ্ডির বাইরে রেখেছেন নিজেকে।

রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য হয়েও সব সময় রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন। তাই বলে তাঁকে রাজনীতিবিচ্ছিন্ন কিংবা রাজনীতিবিমুখ ভাবারও কোনো কারণ নেই। যথেষ্ট রাজনীতিসচেতন শেখ রেহানা আড়াল থেকেই তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। যে পরিবারে তাঁর জন্ম, সেখানে তাঁর ওপরও আলো পড়ার কথা। কিন্তু নিজেকে সে আলো থেকে সযত্নে শুধু নয়, সচেতনভাবেই সরিয়ে রেখেছেন তিনি। এমন নির্মোহ থাকা সবার জন্য সম্ভব হয় না, বিশেষ করে রাজনৈতিক আবহে যাঁদের বেড়ে ওঠা, তাঁদের পক্ষে নিভৃত জীবন কাটানো একেবারে অসম্ভব বলেই মনে হয়।
শেখ রেহানা খুব ভালো করেই জানেন, ক্ষমতার চেয়ার অনেক সময় অনেক মানুষকে বদলে দেয়। সে বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন তিনি। থাকেন লন্ডনে।

নিতান্তই সাধারণ জীবন যাপন করেন। অথচ অন্য রকম হওয়ার কথা ছিল তাঁর জীবন। জাতির জনকের কন্যা তিনি। রাজনীতির চড়াই-উতরাই দেখেছেন খুব কাছ থেকে। জীবনের শুরু থেকেই বলতে গেলে সংগ্রাম করতে হয়েছে তাঁকে। সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধুকে বারবার কারাবরণ করতে হয়েছে। এ সময়গুলোতে তাঁর পরিবারকে নানা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। শেখ রেহানা খুব কাছ থেকে দেখেছেন কিভাবে তাঁর মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব একা সামলেছেন সব ঝড়ঝাপ্টা। দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পরিবারের শীর্ষ নেতার পরিবারটিও আর দশটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই ছিল। সেখানে মনের দৈন্য ছিল না। বরং আড়াল থেকে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার শিক্ষা তিনি পারিবারিক পরিমণ্ডল থেকেই পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর নির্বান্ধব পরবাসে নিজেদের মতো করে জীবনযাপনের অভিজ্ঞতাও তাঁকে ঋদ্ধ করেছে। অভ্যস্ত করেছে পরিমিত জীবনাচারে। কৈশোর উত্তীর্ণ বয়সেই অনুভব করতে হয়েছে শূন্যতা। যে শূন্যস্থান পৃথিবীর কোনো সম্পদ দিয়ে পূরণ করা যায় না। কিন্তু রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে কাউকে তা বুঝতে দেননি। বরং বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে খুঁজে ফিরেছেন আত্মার আত্মীয়দের। যে কথা তিনি এক সাক্ষাৎকারেও উল্লেখ করেছেন। তিনি গৃহকোণচারিণী, কিন্তু গৃহসীমানার মধ্যে সংকুচিত নয় তাঁর জীবন। ঘরে ও বাইরে সমানভাবে চিরায়ত কল্যাণী তিনি।

রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান শেখ রেহানা। বেড়ে ওঠা রাজনীতির আবহে। জন্মের পর থেকেই দেখে এসেছেন বাড়িতে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আসা-যাওয়া। স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক অঙ্গনের মানুষদের সঙ্গে তাঁর নিত্য ওঠাবসা। কিন্তু নিজে এড়িয়ে চলেন সব ধরনের রাজনৈতিক যোগাযোগ। আড়ালে থেকেই মানুষের কল্যাণ কামনা করেন সব সময়। এই কল্যাণমন্ত্রে দীক্ষা তো হয়েছে পারিবারিক সূত্রেই। এই আড়ালচারিতা তাঁর মাহাত্ম্যকে একটুও ম্লান করেনি। বরং পাদপ্রদীপের আলোয় না এসেও তিনি দেশ ও মানুষের কল্যাণে যে অবদান রেখে চলেছেন তা তুলনারহিত। মিতবাক এই নারী নিজেকে উৎসর্গ করেছেন দেশমাতৃকার সেবায়। তাঁর সেই নীরব নিবেদন সাদা চোখে সবার গোচরে আসে না।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ রেহানার অবদান একেবারে কম তো নয়ই, বরং উপেক্ষা করার মতো নয়। প্রত্যেক রাজনৈতিক নেতৃত্বের নেপথ্যে আরো একজনকে পাওয়া যায়, যাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা ছাড়া সাফল্য লাভ ছিল প্রায় অসম্ভব। শেখ রেহানা তেমনই একজন, যিনি সব সময় বড় বোনের পাশে থেকেছেন, তাঁকে সাহস জুগিয়েছেন। প্রবাসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সব সময় তাঁকেই পেয়েছে কাণ্ডারি হিসেবে।

বিশ্বসংসারে এমন আড়ালচারী কিছু মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়। এই বিরল শক্তির মানুষরা নিজেদের নিয়ে কখনো ভাবিত হন না। পাদপ্রদীপের আলোয় নিজেদের আলোকিত করার সব সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও থাকতে পারেন মোহমুক্ত। এমন নির্মোহ থাকা কি সবার দ্বারা সম্ভব হয়? শেখ রেহানা সেই বিরল স্বভাবের আড়ালচারী মানুষদের একজন. যিনি নেপথ্যে থেকেও সুস্থ রাজনৈতিক ধারার আন্দোলন-সংগ্রামে ইতিবাচক শক্তির উৎস।

আজ ১৩ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিন। জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাই তাঁকে। জয়তু শেখ রেহানা।

লেখক : সর্বইউরোপীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি

nazrul@gmx.at

শেয়ার করুন