দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। তপশিল প্রত্যাখ্যান করে অবরোধ-হরতাল চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি ও তার সহযোগী দলগুলো। এ পরিপ্রেক্ষিতে নতুন যে রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে, সে সম্পর্কে কথা বলেছেন দু’জন অধ্যাপক।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি যে রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করেছে, তা হঠকারী, অদূরদর্শী ও বাস্তবতা-বিবর্জিত। তারা এখনও সরকার পতন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রচলনের দাবিতে আটকে আছে। তাদের এ দাবির সঙ্গে জনগণ নেই বলেই তারা তা আদায় করতে পারেনি। একই কারণে সামনের দিনগুলোতেও দাবিটা বাস্তবায়িত হবে না বলে আমি মনে করি।
সংবিধান অনুসারে ইসি বা নির্বাচন কমিশনের একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা আছে। সে অনুসারে তারা ইতোমধ্যে নির্বাচনী তপশিল ঘোষণা করেছে। ইসি ইতোপূর্বে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ করার একাধিক উদ্যোগ নিয়েছে; তারা সরাসরি আমন্ত্রণ জানানোর পাশাপাশি বিএনপিকে এ জন্য চিঠি দিয়েছে। পরোক্ষভাবেও বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। কিন্তু বিএনপি তার অবস্থানে অনড় থেকেছে। অর্থাৎ এক ধরনের পয়েন্ট অব নো রিটার্নে চলে গেছে।
একটা রাষ্ট্র কোনো একটা দলের গোঁয়ার্তুমির কাছে জিম্মি থাকতে পারে না। রাষ্ট্র, সরকার ও জনগণকে একটা সাংবিধানিক ধারায় চলতে হয়। না হলে রাষ্ট্র বড় ধরনের সংকটে পড়ে।
বিএনপি যখন দেখেছে, তাদের এক দফা দাবি জনসমর্থনের অভাবে আদায় হচ্ছে না, তখন দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে তাদের উচিত ছিল সেখান থেকে সরে আসা। সেটা না করে তারা ২০১৩-১৪ ও ’১৫ সালের মতো সহিংসতায় ফিরে গিয়ে একটা বন্ধনী বা ঘেরাটোপে আটকে গেল।
এখন যে তারা গোপন স্থান থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করছে, যেগুলো বাস্তবায়নেরও কোনো উদ্যোগ নেই। সেগুলো এক ধরনের অরাজনৈতিক প্রক্রিয়া, এমনকি খামখেয়ালিপনা। এর মাধ্যমে পেশিশক্তিনির্ভর রাজনীতির চর্চা চলছে। ২০১৩, ’১৪ এবং ’১৫ সালের জ্বালাও-পোড়াও, মানুষ হত্যার রাজনীতির ব্যর্থতা থেকে তারা কোনো শিক্ষা নেয়নি। যে কারণে এখনও তারা একই ধরনের হরতাল-অবরোধ দিচ্ছে। কিন্তু এতে কাজের কাজ কিছুই হবে না; মাঝখানে মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে। শ্রমজীবী, খেটে খাওয়া মানুষ দুর্গতি পোহাবে। অবশ্য এ শ্রেণির মানুষ কষ্ট পেলে বিএনপির কিছু যায়-আসে না। তাদের যে কোনো কিছুর বিনিময়ে ‘সোনার হরিণ চাই’। এটা অপরাজনীতির চেয়েও নিকৃষ্ট।
যা হোক, নির্বাচনের তপশিল ঘোষিত হয়েছে; অনেক রাজনৈতিক দলই এতে অংশ নেবে। নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা যখন শুরু হবে, তখন তার সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়বে। গোটা দেশ একটা নির্বাচনী আবহে ঢুকে যাবে। আর নির্বাচনে না এসে বিএনপি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে। এর মানে হলো, আরও অনেক বছরের জন্য বিএনপিকে ক্ষমতার বাইরে থাকতে হবে।
এখন আবার সংলাপের কথা বলা হচ্ছে। বিশেষ করে আমেরিকা আওয়ামী লীগ-বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে এ বিষয়ে চিঠি দেওয়ার পর সংলাপ নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। কিন্তু যখন সরকারি দল বারবার নিঃশর্ত সংলাপের কথা বলেছে, তখন আমেরিকা কি বিএনপিকে সংলাপে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল? কিংবা এখনও কি বিএনপি বলেছে– হ্যাঁ, আমরা আমেরিকার পরামর্শ মেনে ‘নিঃশর্ত সংলাপে’ বসতে চাই? তারা তা বলেনি। তার মানে, বন্ধু রাষ্ট্রের পরামর্শও বিএনপি মানছে না। এখন দেখার বিষয় হলো, বিএনপি যদি সহিংসতার মাধ্যমে চলমান নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে যায়, তাহলে আমেরিকা তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিএনপির বিরুদ্ধে ভিসা নীতি প্রয়োগ করে কিনা?
সংলাপ নিয়ে আরেকটা কথা বলতে চাই। তা হলো, রাজনীতি একটা খেলা। মাঠের খেলোয়াড় সবাই সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে চায়। সরকারি দল এখন যে সুবিধাজনক অস্থানে আছে, তা ছাড়বে কেন? আর তপশিল ঘোষণার পর বর্তমান সরকারের সংলাপ নিয়ে কোনো ভূমিকা নেই; সরকারি দলের থাকতে পারে। এখন তপশিলের আওতায় বিএনপিকে যতটুকু অ্যাকোমোডেট করা যায় তা করা যেতে পারে। আরেকটা সুযোগ আছে বিএনপির জন্য। তারা রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ চায়নি; সেখানে তারা যেতে পারে। নির্বাচনকালে সংবিধানমতে রাষ্ট্রপতির গুরুত্ব বেড়ে যায়। কারণ, তখন তাঁর নির্বাহী ক্ষমতা বেড়ে যায়। সেখানে গিয়ে বিএনপি তার কথা বলতে পারে। তবে সেখানে এক দফার কথা বলে লাভ হবে না। তারা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে বা লিখিতভাবে বলতে পরে, আমরা যা করেছি তা থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। আমাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের স্বার্থে এই কাজগুলো করা যায়।
যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের পর সরকারের ওপর নানা চাপ দেবে বলে ভয় দেখাচ্ছে। তারা সঠিক বলছে বলে মনে করি না। কারণ গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদি আমেরিকার কাছে কোনো নীতিগত বিষয় নয়। তেমনটা হলে গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যাকে তারা সমর্থন জানাত না। বিশ্বে বহু দেশ, যেখানে গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই; আমেরিকার অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষে আছে। ১৯৯৮ সালে পারমাণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের পর তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আফগানিস্তানে তালেবান সরকার আসার পর আমেরিকা পাকিস্তানে অস্ত্র, অর্থ সবই দিয়েছে। আমেরিকার বিদেশনীতি চলে সম্পূর্ণ তার জাতীয় স্বার্থকে ভিত্তি করে। ফলে দেখা যাবে, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত আমাদের সরকারের সঙ্গে সে বাণিজ্যিক কার্যক্রম আরও জোরদার করেছে। আমেরিকা তার সঙ্গেই বন্ধুত্ব করে যে সরকার ডেলিভার করতে পারে; আওয়ামী লীগের সে ক্ষমতা আছে। আর আমেরিকা কিন্তু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলেছে; সব দলের অংশগ্রহণের কথা বলেনি।
আমার মতে, বিএনপি এখন বলতে পারে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয় কিনা, তার শেষ পরীক্ষা হিসেবে আমরা আন্দোলনের অংশ হিসেবেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছি। এর মধ্যে কিন্তু সারবত্তা আছে। কারণ, এবারের নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করা জাতীয় দাবি; ভোটে অবশ্যই জনরায় প্রতিফলিত হতে হবে। সেটা না হলে সংশ্লিষ্টদের খেসারত দিতে হবে।
লেখক: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও প্রাক্তন উপাচার্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়