মন্ত্রণালয়গুলোর কর্মকাণ্ডের জবাবদিহি, সংসদে উপস্থাপিত আইন পর্যালোচনাসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়। সংসদ সদস্যদের মধ্যে থেকে একজনকে সভাপতি করে সংসদ নেতার অনুমতিতে জাতীয় সংসদের চিফ হুইপের প্রস্তাবে কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী, নির্বাচিত ও সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্যদের নিয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠিত হয়। এ ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের কণ্ঠভোটের প্রয়োজন হয়। অপরদিকে কয়েকটি কমিটি স্পিকার নিজেই অনুমোদন দেন এবং তা সংসদে ঘোষণা করেন।
কমিটিতে সভাপতিসহ ১০ জন সংসদ সদস্য থাকেন। এর মধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী পদাধিকার বলে কমিটির সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। তবে, মন্ত্রী সংসদ সদস্য না হয়ে টেকনোক্র্যাট কোটার হলে তিনি কমিটির সদস্য হতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে সভাপতির বিশেষ আমন্ত্রণে তিনি কমিটির বৈঠকগুলোতে অংশ নেন।
চলতি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ৫০টি সংসদীয় কমিটির সবগুলোই এরইমধ্যে গঠন করা হয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়াদের মধ্য থেকে এবার ১৩ জন সংসদীয় কমিটির সভাপতি হয়েছেন। এছাড়া এবার প্রথমবারের মতো সংসদীয় কমিটির সভাপতি হয়েছেন ১৫ জন। একাদশে সংসদীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালনকারীদের মধ্যে ১৬ জন সংসদ সদস্য দ্বাদশ সংসদেও সভাপতি হয়েছেন। অবশ্য তাদের বেশিরভাগেরই মন্ত্রণালয় পরিবর্তন হয়েছে। এবার একজন জাতীয় পার্টির ও একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য কমিটির সভাপতি হয়েছেন।
কমিটির সভাপতির মর্যাদা
কার্যত বিশেষ কোনও পদমর্যাদা না থাকলেও সংসদীয় কমিটি নিয়ে জনমনে বেশ আগ্রহ দেখা যায়। মন্ত্রিসভা, সংসদ উপনেতা, চিফ হুইপ ও হুইপদের মধ্যে সংসদীয় কমিটির সভাপতি কারা হলেন—তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতূহল তৈরি হয়। মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়া বা অন্য সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে সংসদীয় কমিটির সভাপতি কারা হলেন, তা নিয়ে নেতাকর্মীসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটারদের মধ্যেও ব্যাপক উৎসাহ দেখা যায়।
আবার সংসদীয় কমিটির সভাপতিরা কী সুবিধা পেয়ে থাকেন, তাদের পদমর্যাদাই বা কী, এ নিয়ে মানুষের কৌতূহলের কমতি নেই। তবে বাস্তব অর্থে মর্যাদাক্রম অনুযায়ী সংসদীয় কমিটির সভাপতিদের আলাদা কোনও পদমর্যাদা নেই। তারা সংসদ সদস্যদের পদমর্যাদা ভোগ করেন। এর বাইরে সংসদীয় কমিটির সভাপতি হিসেবে সংসদ সচিবালয় থেকে সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে সরকারিভাবে সুসজ্জিত একটি অফিস বরাদ্দ পান। এর বাইরে একজন ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ), একজন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া অফিসে আপ্যায়ন খরচ বাবদ ২০ হাজার টাকা মাসিক ভাতা বরাদ্দ পান।
যেসব সুযোগ-সুবিধা পান কমিটির সভাপতিরা
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংসদীয় কমিটি বিভিন্ন সময় সরকারি পরিবহন পুল থেকে গাড়ি, জ্বালানি ও ড্রাইভার বরাদ্দের দাবি জানালেও তা কার্যকর হয়নি। এ সংক্রান্ত প্রস্তাবনা একাধিকবার মন্ত্রণালয়ে গেলেও তা নাকচ করা হয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ স্পিকার থাকাকালে সংসদীয় কমিটির সভাপতিদের গাড়িতে জাতীয় সংসদের লোগো সংবলিত পতাকা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। কমিটির সভাপতিরা এ সুবিধা এখনও ভোগ করছেন।
এছাড়া বিভিন্ন সময়ে কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনও সরকারি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে সংসদীয় কমিটির সভাপতিকে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সরকারি কর্মসূচিতে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে বিশেষ অতিথির আসনে বসার সুযোগ দেওয়া হয়। এছাড়া সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কোনও বিদেশ সফরের ইস্যু এলে সংসদীয় কমিটির সভাপতিসহ কমিটির সদস্যদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
কমিটির ক্ষমতা
সংসদীয় কমিটির কোনও নির্বাহী ক্ষমতা নেই। তারা কেবল বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশ, মতামত ও পর্যবেক্ষণ দিতে পারেন। তবে, তাদের সুপারিশগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে থাকে।
সংসদীয় ব্যবস্থায় সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো ‘ওয়াচডগ বডি’ হিসেবে কাজ করে। সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ভূমিকা পালনের পাশাপাশি কমিটি সংসদীয় কার্যক্রমের সঙ্গে জনগণকে সম্পৃক্ত করে।
মন্ত্রণালয়ের কাজকর্মের অনিয়ম ও দুর্নীতি হলে তা তদন্ত করে প্রতিকারের জন্য সংশ্লিষ্টদের কাছে প্রয়োজনীয় সুপারিশ ও পরামর্শ দেয় এসব কমিটি। এতে নির্বাহী বিভাগ জাতীয় সংসদ বা জনপ্রতিনিধিদের কাছে কিছুটা হলেও জবাবদিহি করতে বাধ্য হয়।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৭৬ অনুচ্ছেদে জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটি গঠনের বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। সংবিধানে সুনির্দিষ্ট করে দুটি কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। তা হলো, সরকারি হিসাব কমিটি ও বিশেষ অধিকার কমিটি। এছাড়া সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে নির্দিষ্ট অন্যান্য স্থায়ী কমিটি গঠন করার কথাও সংবিধানে রয়েছে। সংবিধান ও কার্যপ্রণালি বিধির নির্দেশনা অনুযায়ী বর্তমানে ৫০টি সংসদীয় কমিটি রয়েছে। এর মধ্যে ১১টি সংসদ সম্পর্কিত ও ৩৯টি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
সংবিধানের ৭৬ অনুচ্ছেদের দফা (২)-এ সংসদীয় কমিটির ক্ষমতা ও কার্যাবলির বর্ণনা রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কমিটি সংবিধান ও অন্য কোনও আইন সাপেক্ষে খসড়া বিল ও অন্যান্য আইনগত প্রস্তাব পরীক্ষা করতে পারবে। আইনের বাস্তবায়ন পর্যালোচনা এবং অনুরূপ বাস্তবায়নের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব করতে পারবে। জনগুরুত্বসম্পন্ন বলে সংসদ কোনও বিষয় সম্পর্কে কমিটিকে অবহিত করলে, সে বিষয়ে কোনও মন্ত্রণালয়ের কার্য বা প্রশাসন সম্বন্ধে অনুসন্ধান বা তদন্ত করতে পারবে। কোনও মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি সংগ্রহের এবং প্রশ্নের মৌখিক বা লিখিত উত্তর লাভের ব্যবস্থা করতে পারবে। সংসদ কর্তৃক অর্পিত অন্য যেকোনও দায়িত্ব পালন করতে পারবে।
কমিটির কাজ
সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে প্রতিটি কমিটির কাজের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। বিধিতে বলা হয়েছে—স্থায়ী কমিটির কাজ হবে সংসদ কর্তৃক ওই কমিটিতে পাঠানো যেকোনও বিল বা বিষয় পরীক্ষা করা, কমিটির আওতাধীন মন্ত্রণালয়ের কার্যাবলি পর্যালোচনা করা, মন্ত্রণালয়ের কার্যকলাপ বা অনিয়ম ও গুরুতর অভিযোগ তদন্ত করা এবং কমিটি যথোপযুক্ত মনে করলে ওই কমিটির আওতাধীন যেকোনও বিষয় সম্পর্কে পরীক্ষা করা ও সুপারিশ প্রদান করা। কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মাসে অন্তত একটি বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। অবশ্য সংসদ সম্পর্কিত কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠানের ব্যাপারে এভাবে কিছু বলা নেই।
আগে সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরাই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের সরকারের সময় কার্যপ্রণালি বিধিতে সংশোধন আনা হয়। তখন থেকে সাধারণ সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে কমিটির সভাপতি নির্বাচন করা হয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে পদাধিকার বলে কমিটির সদস্য করা হয়। এরপর থেকে এ পদ্ধতিতে কমিটি গঠন হয়ে আসছে। আগে সরকারি দলের এমপিদের মধ্য থেকে কমিটির সভাপতি নির্বাচন করা হলেও নবম সংসদ থেকে বিরোধী দলসহ অন্য দলগুলো থেকেও সভাপতি হচ্ছেন।