প্রচণ্ড দাবদাহ আমাদেরই সৃষ্টি

অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার

ফাইল ছবি

মানবশরীরের তাপমাত্রা ও পানির সাম্যতা রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে কোনো কারণে যদি ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়, তখন পুরো ব্যবস্থাপনাই ভেঙে পড়ে। এজন্য থামোরেগুলেশন ও অসমোরেগুলেশন মানবশরীরসহ অন্য প্রাণীর জন্য অত্যাবশ্যক কার্যক্রম। ছোটবেলা খেকে আমরা শুনে আসছি, অতিরিক্ত যে কোনো জিনিসই খারাপ। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খাবারও শরীরের জন্য বিষ। ভারসাম্যতা বা হোমিওস্ট্যাটিস সামাজিক জীবন, ব্যক্তিগত জীবন ও পরিবেশ—সব ক্ষেত্রেই অতীব জরুরি। মানবশরীরে পানি ও তাপের ভারসাম্যতা পরিবেশের তাপমাত্রার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পরিবেশের অন্যান্য উপাদান ও জনস্বাস্থ্যে সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে। শারীরবৃত্তীয় সব কার্যক্রম সঠিকভাবে চলতে শরীরের তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকা জরুরি। এই তাপমাত্রায় শরীরের সব এনজাইম হরমোন সঠিকভাবে কাজ করে। যদি এর চেয়ে বাড়তে থাকে, তাহলে নেগেটিভ কিডব্যাকের মাধ্যমে শরীর তা ঠিক রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু অতিরিক্ত বেড়ে গেলে শরীরের হোমিওস্ট্যাটিস প্রক্রিয়া আর কাজ করে না।

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার হিসাব অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট জায়গার দৈনিক যে গড় তাপমাত্রা বিরাজ করে, তা থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেলে এবং তা পরপর পাঁচ দিন চলমান থাকলে তাকে হিটওয়েভ বলা হয়। আমাদের দেশে এই হিটওয়েভ শুরু হয় ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে (আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভাষ্যমতে)। বর্তমানে কিছু কিছু স্থানে তা প্রায় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাহলে বুঝতে আর বেশি কষ্ট হওয়ার কথা নয়, আমরা কি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। বিগত ৭৬ বছরের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে প্রচণ্ড দাবদহে জ্বলছে সারা দেশ। এই পরিস্থিতি কি মানবসৃষ্ট, নাকি প্রকৃতির প্রতিশোধ? আমরা যেভাবেই বলি না কেন, মূল কারিগর হলো মানুষ। কারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধির সব প্যারামিটার আমরা মাত্রাতিরিক্তভাবে বাড়িয়েই চলেছি। খুব গভীরভাবে না ভাবলেও হবে। সাধারণভাবেই যদি চিন্তা করেন, দেশে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার প্রতিক্ষণ বাড়ছে, না কমছে? প্রতিদিন ব্যক্তিগত ও প্রতিষ্ঠানিক গাড়ির সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। বাড়ছে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর পরিমাণ। সারা বিশ্বের জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর কাজ প্রতিদিন বেড়েই চলছে। এই সঙ্গে আমাদের দেশের তো কথাই নেই। প্রতিদিন রেফ্রিজারেটর ও এসি ব্যবহারের পরিমাণ এক্সপোনেনশিয়ালভাবে বেড়েছে। বেড়েছে বনায়ন ধ্বংসের পরিমাণ, অকল্পনীয়ভাবে এবং অপরিকল্পিতভাবে বেড়েছে কংক্রিটের বাড়িঘর।

জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক কর্মপরিকল্পনার তথ্য অনুসারে কোনো আইডিয়াল শহর হলো যে শহরে ২৫ শতাংশ বনায়ন বা গাছপালা আছে। ২০২০ সালের এক জরিপে দেখা যায়—ঢাকা শহরে বনায়নের পরিমাণ ৮ শতাংশ। বর্তমানে তা আরো কমে যাচ্ছে। বিপরীত দিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ইট-পাথরের ইমারত আর ইট বানানোর ভাটা। ঢাকা শহরের প্রতিটি সিগন্যালে প্রতিদিন পড়ছে বিশাল বিশাল জ্যাম, যা অকল্পনীয়ভাবে গ্রিন হাউজ গ্যাসের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা এমন এক ট্র্যাপ তৈরি করছে, যার মধ্যে সূর্যের আলো প্রবেশ করছে কিছু কিছু ওয়েভ লেন্থ বা তরঙ্গ দৈর্ঘ্য পরিবর্তন করে আর সেই ট্র্যাপ থেকে বের হতে পারছে না। যার ফলে প্রতিনিয়তই তাপমাত্রা বাড়ছে। একইভাবে কিছু গ্যাস ওজোন (O3­­)-এর সঙ্গে বিক্রিয়া করে তা ছিন্দ্র করে ফেলছে এবং এই ছিদ্র দিয়ে আরো ভয়ংকর অতিবেগুনি রশ্মি প্রবেশ করে ক্যানসারের মতো ভয়াবহ রোগ তৈরি করছে। একইভাবে তাপমাত্রাও বাড়ছে। এই নাজুক পরিস্থিতির অবসান কীভাবে সম্ভব তাই বলছি।

প্রথমত : দেশের সব বড় বড় শহরে বনায়নের শতকরা ভাগ নির্ণয় করতে হবে। এটা ধরিত্রীর কুলিং সিস্টেম হিসেবে কাজ করে। মানবদেহের ফুসফুস যেমন পরিষ্কার বাতাস গ্রহণ করে রক্ত পরিষ্কার করে, দেহের সব কার্যক্রম ঠিক রাখে, তেমনিভাবে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বনায়ন কোনো এলাকার সব দূষিত বাতাস বা কার্বন ডাই-অক্সাইডযুক্ত বাতাস গ্রহণ করে অক্সিজেনযুক্ত বাতাস সরবরাহ করে। দ্বিতীয়ত : শহরাঞ্চলে যেসব পার্ক বা বিনোদনের জায়গা আছে, সেসব স্থানে সবুজ গাছপালা সংরক্ষণ ও বর্ধন নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত : বনায়ন ধ্বংসের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত আইনের প্রয়োগ হতে হবে যথাযথভাবে। চতুর্থত : যেসব জলাধারের পাড়ে ব্যক্তিমালিকানায় গাছপালা আছে, সেগুলো সংরক্ষণে জনসচেতনতা ও সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।

এবারের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের স্লোগান- ‘আমার স্বাস্থ্য, আমার অধিকার’। এ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে দুটি বিষয় প্রতীয়মান হয়, তা হলো—১. স্বাস্থ্যে আমার নিজের দায়িত্ব ২. স্বাস্থ্য আমার অধিকার। স্বাস্থ্যকে বিশ্বের কমপক্ষে ১৪০টি দেশ মানবাধিকার হিসেবেই বিবেচনা করে তাদের নিজ নিজ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই অধিকার সংরক্ষণের পথে অনেকগুলো বাধা আছে। যেমনভাবে যুদ্ধবিগ্রহ, হানাহানি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে মানবাধিকার খর্ব হচ্ছে, একইভাবে পরিবেশের ওপর নির্মম নিষ্ঠুর আচরণ করে প্রকৃতিকে করে তুলছি বিরূপ। তাই শান্তি স্থাপন করে প্রকৃতির সহজাত অবস্থান ফিরিয়ে এনে আমার অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো, নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি নিজে মনোনিবেশ করা।

লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিত্সা প্রতিষ্ঠান (নিপসম), মহাখালী, ঢাকা

শেয়ার করুন