শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন : ইতিহাসের নতুন যাত্রা

র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস
ফাইল ছবি

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে দীর্ঘ নির্বাসন শেষে তিনি বাংলার মাটিতে ফিরে আসেন। এদিন বিকাল সাড়ে ৪টায় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের একটি বোয়িং বিমানে তিনি ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে তত্কালীন ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান। সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে প্রিয় স্বদেশভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন শেখ হাসিনা। দীর্ঘ ছয় বছর নির্বাসন শেষে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে ফিরে আসেন তিনি। সেদিন রাজধানী ঢাকা মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ঢাকা শহর মিছিল ও স্লোগানে প্রকম্পিত হয়। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া আর প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টিও সেদিন লাখো মানুষের মিছিলকে গতিরোধ করতে পারেনি। কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও শেরেবাংলা নগর পরিণত হয় জনসমুদ্রে।

এ কথা সবারই জানা, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্ধকারে প্রবেশ করে। এ সময় থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত নানা ষড়যন্ত্রে ক্ষতবিক্ষত আওয়ামী লীগ। কিন্তু দেশব্যাপী নেতাকর্মীদের সুদৃঢ় মনোভাবের কারণে ১৯৮১-এর ১৬ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে জাতির জনকের জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচন করা হয় এবং সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন আব্দুর রাজ্জাক। শেখ হাসিনা তখন নির্বাসনে এবং একসময় ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত থাকলেও সুদীর্ঘ সময় রাজনীতি থেকে দূরে থেকেছেন। কিন্তু জাতির জনকের নেতৃত্বে বাঙালির আন্দোলন-সংগ্রাম আর রাষ্ট্র পরিচালনা দেখেছেন তিনি কাছে থেকে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ের নির্বাসিত জীবনও তাকে রাজনীতির গভীর পর্যবেক্ষণের সুযোগ করে দেয়। অতএব রাজনীতিতে তিনি একেবারেই আনকোরা ছিলেন না। তাই সভাপতি পদে বৃত হওয়ার পর পরই তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৮১ সনের ১৭ মে এক বর্ষণমুখর দিনে তিনি স্বদেশের মাটিতে পা রাখেন। যেন দেশমাতৃকা তার প্রিয় সন্তানকে কোলে ফিরে পেয়ে আনন্দাশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন এবং একই সঙ্গে প্রকৃতি যেন এই দুঃখী পিতৃমাতৃহীন কন্যার সমব্যথী হয়ে কান্নার জলে তাকে বরণ করে নিচ্ছে।

স্বদেশে ফিরে আসার পর শুরু হয় আওয়ামী লীগের এই নতুন নেতার সংগ্রামের নতুন বন্ধুর পথের অভিযাত্রা। একদিকে পিতার হন্তারক সামরিক স্বৈরতন্ত্রের দোসরদের পদচারণা, অন্যদিকে দলের অভ্যন্তরের নেতৃত্বাভিলাষী নানা নেতা ও গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত। পিতৃমাতৃ ও স্বজনহারা হাসিনা পাড়ি দিচ্ছেন এক অজানার উদ্দেশে, যার সঙ্গীদের অনেকেই বিশ্বস্ত নন। কঠিন কঠোর বন্ধুর এ পথযাত্রা। কিন্তু অবিচল দৃঢ় প্রত্যয়ী হাসিনা বিভ্রান্তির বেড়াজালে পা দেননি। দেশে ফিরেই তাকে এক অভিনব পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হলো। ৩০ মে ৮১-তে স্বৈরশাসক জিয়া নিহত হলেন সেনাবিদ্রোহীদের হাতে। দেশের মাটিতে ফিরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার অবকাশ পাওয়ার আগেই এই অভিনব ঘটনা, যা তার নেতৃত্বকে শুরুতেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করায়। এ সময়টা আমি তাকে খুবই কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাই। দৃঢ়চেতা, নির্ভীকচিত্ত তাকে পিতার মতোই সাহসী পায়ে দাঁড়াতে দেখতে পাই। পরিস্থিতি মোকাবিলা করলেন অবিচলিত থেকে। এ সময়টাই আমি তার নেতৃত্বের সূচনাটা দেখলাম গভীর উত্কণ্ঠায়। সব দুশ্চিন্তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে তিনি উতরে গেলেন এই কঠিন পরিস্থিতি।

১৯৮১, ১৯৮২ প্রথমে গণতান্ত্রিক শাসনের ছদ্মাবরণে বিচারপতি সাত্তারের নৈরাজ্যের শাসন এবং পরে নেপথ্যের কুশীলব জেনারেল এরশাদের সমূর্তিতে আবির্ভাব। পরিপূর্ণ স্বৈরতান্ত্রিক সামরিক শাসন। পাশাপাশি দলের অভ্যন্তরে নানা মত ও পথের উপদলীয় কোন্দল। ক্ষতবিক্ষত দল। ১৯৮৩-তে এসে শেখ হাসিনা দলের অভ্যন্তরের চক্রান্তে একটি বড় ধরনের সাংগঠনিক ধাক্কা খেলেন। আব্দুর রাজ্জাক ও মহিউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে দলের অভ্যন্তরের একটি বড় অংশ দল ছেড়ে চলে যান এবং বাকশাল নাম দিয়ে নতুন একটি দল গঠন করেন। তারও আগে এই উপদলের নেতৃবৃন্দ ছাত্রলীগকে দ্বিধাবিভক্ত করেন এবং জাতীয় ছাত্রলীগ নাম দিয়ে একটি ছাত্রসংগঠন গড়ে তোলেন। রাজ্জাক-মহিউদ্দিনের এই ভাঙন দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে বেশ দুর্বল করে দেয়। এ সময়টাতে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব সত্যিকারের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। শেখ হাসিনা অত্যন্ত ধৈর্য ধরে পরিস্থিতির মোকাবিলা করেন। বলতে দ্বিধা নেই যে, দলের ভাঙনরোধে শেখ হাসিনা সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। এর সাক্ষী ওবায়দুল কাদের আর আমি। কিন্তু দলের অভ্যন্তরের কট্টর ডানপন্থিদের কূটকৌশল এবং রাজ্জাকপন্থিদের অনমনীয় অবস্থান তার সব প্রকার প্রয়াসকে ভেস্তে দেয়। দল ভেঙে যায়। তিনি এ সময়ে খুবই ধৈর্য, সহনশীলতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবিলা করেন। বাকশালপন্থিরা তাকে আদর্শিক দিক থেকে এবং ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করলেও তিনি ধৈর্যহারা হননি। সারা দেশের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তিনি ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে দলকে আঘাত থেকে সারিয়ে তুলতে বিরামহীন পরিশ্রম করতে থাকেন। স্বজনদের ভালোমন্দের খোঁজখবর বা নিজের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা না করে উদয়াস্ত পরিশ্রমের এক কঠিন সংগ্রামের পথ বেছে নেন। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বৈরতান্ত্রিক দুঃশাসন আর সাংগঠনিক ক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতকতা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুললেও বিচলিত ও বিভ্রান্ত করতে পারেনি। অবিচল ও অভ্রান্ত পথের দিশা ধরে তিনি পিতার আদর্শকে বুকে ধারণ করে এগোতে থাকেন দৃঢ় পদচারণায়।

আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শেখ হাসিনাকে অনেক কঠিন সময় ও বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। ক্ষুদ্র পরিসরে তা লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয়। শুধু আমি বলতে পারি যে, রাষ্ট্রীয় ও দলীয় উভয় ক্ষেত্রেই তাকে হাঁটতে হয়েছে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে, কিন্তু দেশব্যাপী বঙ্গবন্ধুর লাখ-কোটি আদর্শিক কর্মী যেমন তাকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে গেছেন এবং জনগণের মধ্য থেকে তিনি যে সমর্থন ও ভালোবাসা পেয়েছেন, তা-ও কম প্রাপ্তি নয়। কর্মীদের প্রতি স্নেহ-মমতায় তিনি যেমন মাতৃসমা, তেমনি সহকর্মীদের প্রতিও তার সহমর্মিতা ও সহযোগিতা অতুলনীয়। নেতাকর্মীদের আনন্দ-বেদনায় তার অংশগ্রহণ যে কোনো রাজনৈতিক নেতার জন্যই ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশে তিনি এসেছিলেন একজন নিঃস্ব ব্যক্তি হিসেবে, অভিভাবকহীন। আর আজ তিনিই লাখ-কোটি নিঃস্ব মানুষের ভরসাস্থল এবং কোটি অসহায় মানুষের অভিভাবক। আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও তিনি সেদিন ছিলেন একজন কর্মী মাত্র আর আজ তিনি একজন নেতাই শুধু নন, একজন সফল রাষ্ট্রনায়কও বটে। কর্মী থেকে রাষ্ট্রনায়কে উত্তরণের এই পথপরিক্রমায় স্নেহময়ী এই জননী একজন দৃঢ়চেতা সাহসী সেনাপতি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে। পিতার যোগ্য উত্তরসূরি এই পুত্রী এক অনন্য ব্যক্তি হিসেবে এবং আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছেন।

শেখ হাসিনাকে ভবিষ্যত্ ইতিহাস যেভাবেই মূল্যায়ন করুক না কেন, তিনি যে একজন সফল ও যোগ্য রাষ্ট্রনেতা, এ কথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। পিতৃমাতৃ-ভ্রাতৃহারা, স্বজনহারা একজন রাজনীতিক বুকে শোকের পাথর বেঁধে জনগণের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন অক্লান্তভাবে। যে কোনো মানবিক বিচারেই তার এই অবিরাম পথচলাকে আশ্চর্য ও অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখবে ইতিহাস এবং বিচারও করবে নির্মোহ এক দৃষ্টিকোণ থেকে। ইতিহাসের কোনো পক্ষপাত নেই। যদিও এ কথা সত্য যে, ইতিহাস শুধু বিজয়ের পক্ষেই দাঁড়ায়। পরাজয়ের কোনো যোগ্য স্থান নেই ইতিহাসে। কেননা বিজয়ই তো ইতিহাসের গতিপথকে নির্ধারণ করে। ২১ বার যার জীবনের ওপর হামলা হয়েছে, যাকে স্বৈরতন্ত্রী সরকারসমূহের সঙ্গে কৌশলী লড়াই চালিয়ে আজকের জায়গায় এসে দাঁড়াতে হয়েছে, ইতিহাসকে তো তার বিষয়ে বিচার করতে অনেক হিসাব কষেই এগোতে হবে। সব মানবিক গুণই তার মধ্যে কাজ করে। নির্লোভ এই রাজনীতিক রাজনীতিকে জনগণের কল্যাণ সাধনের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছেন। স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসায় অতুলনীয় এই মানুষটি স্নেহান্ধও নন, বিনম্র হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অটল ও দৃঢ়।

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সত্যিকার অর্থে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের ইতিহাসের নতুন পথের যাত্রা শুরু। তার নেতৃত্বে পরবর্তী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় স্বৈরশাসক এরশাদের পতন হয়, বিএনপি জামায়াতের মুখোশ উন্মোচিত হয় এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রুদ্ধদ্বার হয় উন্মোচিত। নানা চড়াই-উতরাই ও ষড়যন্ত্রের কণ্টকাকীর্ণ বন্ধুর পথ অতিক্রম করে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দরবারে স্বমহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো অমিত সম্ভাবনার উদীয়মান এক অর্থনীতি। বঙ্গবন্ধুকন্যার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সবচেয়ে বড় সার্থকতা এখানেই।

শেখ হাসিনা তার জীবনের সবকিছুতেই স্থান দিয়েছেন মানবকল্যাণ। আইনের শাসনকে প্রতিষ্ঠিত করে সুশাসন নিশ্চিত করছেন শুধুই তার একক দৃঢ়চিত্ততার কারণে। জলেস্থলে অন্তরিক্ষে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে যিনি একাগ্রচিত্তে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন, তিনি শেখ হাসিনা। আমরা কায়মনোবাক্যে তার জীবনের সর্বাঙ্গীণ সাফল্য কামনা করি।

তার জয় হোক। জয় শেখ হাসিনা।

লেখক : মন্ত্রী, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং ’৭৫-পরবর্তী প্রতিরোধযোদ্ধা

শেয়ার করুন