রাজধানীর গুলশানসহ বিভিন্ন এলাকায় বসে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। দুই তিন মাস আগে এই পরিকল্পনা করা হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে ঢাকায় তা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছিল না। ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। ফলে কলকাতাকেই হত্যাকাণ্ডের জন্য নিরাপদ মনে করেন খুনিরা।
সে অনুয়ায়ীই কলকাতার নিউটাউনের অভিজাত এলাকার ফ্ল্যাটে এমপি আজীমকে হত্যার পর লাশ টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেওয়া হয়। এই পরিকল্পনার প্রধান মাস্টারমাইন্ড এমপির বাল্যবন্ধু ও ব্যবসায়ীক পার্টনার আক্তারুজ্জামান শাহীন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
ডিবির এই অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, রাজধানীর গুলশানসহ বিভিন্ন এলাকায় বসে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন তার বাল্যবন্ধু ও ব্যবসায়ীক পার্টনার আক্তারুজ্জামান শাহীন। শাহীনের পরিকল্পনায় হত্যার কাজটি করেন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আমান উল্লাহ আমান ওরফে শিমুল।
হারুন বলেন, শাহীন দুই থেকে তিন মাস ধরে আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। তবে গোয়েন্দা পুলিশের শক্তিশালী তদন্ত ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে তারা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কলকাতাকে বেছে নেয়।
ডিএমপির গোয়েন্দা প্রধান বলেন, কলকাতায় গত ১৩ মে সংসদ সদস্য আনারকে অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তার লাশ গুম করার জন্য পৈশাচিকভাবে মরদেহ টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের কাছে ঘটনায় জড়িত মূলহত্যাকারীসহ আটক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে আমরা জানতে পারি সংসদ সদস্য আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় দুই থেকে তিন মাস আগে।
হারুন জানান, ঢাকার গুলশান ও বসুন্ধরায় বসে একাধিকবার আলোচনা করেছে পরিকল্পনাকারীরা। আনারকে হত্যা করতে প্রথমে তারা দেশের মাটি ব্যবহার করতে চেয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে পুলিশের তদন্ত সক্ষমতার কথা চিন্তা করে তারা দেশের বাইরের মাটিতে পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত ২৫ এপ্রিল কলকাতায় তারা বাসা ভাড়া করে। সে বাসায় নিহত সংসদ সদস্যের বন্ধু আক্তারুজ্জামান শাহীন, তার বান্ধবী এবং পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আমান উল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ওঠেন। গত ৩০ তারিখ ঢাকা থেকে বিমানে করে কলাকাতায় গিয়ে সেই বাসায় ওঠেন তিনি। মূলত পরিবার নিয়ে থাকার তথ্য দিয়ে বাড়ির মালিকের সঙ্গে চুক্তি করেন শিমুল।
তিনি আরও বলেন, হত্যাকারীরা দুই মাস ধরে সংসদ সদস্যকে নজরদারিতে রাখছিলেন। কখন সে কলকাতায় যায়। সংসদ সদস্য বিভিন্ন সময়ে কলকাতায় যেতেন। সেখানে তিনি দীর্ঘদিন বাস করেছেন। সেখানে তার বন্ধ-বান্ধব রয়েছে। তারা এই সুযোগটি কাজে লাগিয়েছেন। সংসদ আনার কলকাতায় গিয়ে তার বন্ধুর গোপালের বাসায় গিয়ে ওঠেন। তারা জানত ১২ তারিখ সংসদ সদস্য কলকাতায় যাবেন। হত্যার পরিকল্পনাকারীরা ৩০ এপ্রিল কলকাতায় গিয়ে স্থানীয় দুজনকে ঠিক করে। তারা হলেন- জিহাদ ওরফে জাহিদ ও সিয়াম। হত্যার পরিকল্পনাকারী শাহীন হত্যার পর কোন গাড়ি ব্যবহার করা হবে। কাকে কত টাকা দিতে হবে। সেগুলো ঠিক করে ১০ মে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। নিহত সংসদ সদস্য কলাকাতায় যাওয়ার পর ১৩ তারিখ ওই বাসায় যান। যাওয়ার পথে একটি সাদা গাড়িতে করে ফয়সাল নামের এক ব্যক্তি তাকে নিয়ে যায়। গাড়িটি কিছু পথ যাওয়ার পরে হত্যাকারী আমান উল্লাহ সেই গাড়িতে ওঠে। গাড়িটির চালক ছিলেন রাজা। সেই বাসায় যাওয়ার পর মোস্তাফিজসহ তারা বাসায় প্রবেশ করে। বাসাটিতে আগে থেকে জাহিদ ও সিয়াম অবন্থান করছিলেন। ১৩ তারিখ দুপুরে ২টা ৫১ মিনিটে বাসায় প্রবেশ করেন। এর ৩০ মিনিটের মধ্যেই হত্যা করা হয় সংসদ সদস্য আনারকে। হত্যার পরে ঘাতকরা সংসদ সদস্যের মোবাইল ফোন দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ম্যাসেজ পাঠায়। এরপর তারা হাড় থেকে মাংস আলাদা করে। পরবর্তীতে দুটি ব্রিফকেসে করে জিহাদ ও সিয়াম মরদেহ গাড়িতে করে ফেলে দেয়। হত্যার পরে সংসদ সদস্যের চিহ্ন না থাকে। কাজ শেষ করে ১৫ তারিখ আমান উল্লাহ ও শাহীনের প্রেমিকা শিরিস্তি দেশে ফিরে আসে। সবাই ফিরে আসায় হত্যার মাস্টার মাইন্ড শাহীন বিমানে করে দিল্লি সেখানে ২ ঘণ্টার ট্রানজিট নিয়ে কাঠমুন্ডু যায়। সেখান থেকে অন্য কোনো দেশে চলে যান।
হারুন আরও বলেন, হত্যার বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পরে দেখা গেছে, হত্যাকারীরা তদন্তকারীদের ভিভ্রান্ত করতে নিহত সংসদ সদস্যের দুটি মোবাইল ফোন দুই দিকে নিয়ে যায়। এরপর তারা বিভিন্ন জনকে বার্তা পাঠানো ও কল করতে থাকে। ফলে যাতে তদন্তকারীরা বুঝতে পারে তিনি জীবিত আছেন। এমন কি গত ১৮ তারিখ এমপির ব্যক্তিগত সহকারীকে একটি ম্যাসেজ পাঠায় যে, ‘আমি দিল্লি যাচ্ছি। আমার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আছেন। দিল্লির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত সাহার সঙ্গে আমার একটি মিটিং আছে।’ এই বার্তাগুলো আমার যখন পেয়েছি তখনই বুঝতে পেরেছি হত্যাকারীরা নিজেদের আড়াল করতে এই বার্তা পাঠিয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে তারা এই হত্যাটি করেছে।