এখন দেশে হট আলোচনার বিষয় বেনজীর আহমেদ। পুলিশের সাবেক এই প্রধান আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ কোথায় পেয়েছিলেন, কীভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন সেসব নিয়ে মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন, অনেক কৌতূহল। কারা তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে, এখন তাদের ভূমিকা কি- এসব প্রশ্ন মুখে মুখে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার একদিকে যেমন দেশের অনেক দৃশ্যমান উন্নতি করেছে, অন্যদিকে বেনজীর আহমেদের মতো কিছু দুর্বৃত্তেরও সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার আগে বেনজীরদের পাকড়াও করার কোনো উপায় কি নেই?
রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি ভুল রাজনৈতিক নীতি-কৌশলের কারণে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, সরকারের ওপর কোনো ধরনের চাপ তৈরি করতে পারছে না। আবার টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে ক্রমাগত আপস করে চলতে গিয়ে আওয়ামী লীগও যেন খাবি খাচ্ছে। রাজনৈতিক বিরোধীরা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে না পারলেও সরকার ভেতর থেকেই ক্ষয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে বলে মনে হচ্ছে। দেশে আসলে কি হচ্ছে, তা নিয়ে চলছে নানা ধরনের গসিপ।
আমার মতো যারা সরকারের হিতাকাঙ্ক্ষী আছেন, তারা এক বিব্রতকর অবস্থায় আছেন বলে আমার মনে হয়। যারা সরকারের সমালোচক তারা আমাদেরও সমালোচনা করে বলেন, আমাদের নিঃশর্ত সমর্থনের কারণেই নাকি সরকার ভালো হওয়ার চেষ্টা না করে খারাপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে। সরকার এটা নিশ্চিত ধরে নিয়েছে যে আমাদের মতো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার মানুষেরা কোনোভাবেই বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক ধারার পক্ষে যাবে না। সেজন্য সরকারের মধ্যে এক ধরনের বেপরোয়া মনোভাব আছে। কিন্তু যারা সরকার চালাচ্ছেন, তাদের মনে রাখতে হবে, আজকের দিনটাই শেষ দিন নয়। সামনে আরও দিন আছে। আর দিন দিন যে মানুষ সরকারের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার দেখে।
আজকের আলোচনাটা অবশ্য একটি বিশেষ বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের দিক বিবেচনা করলে এ বিষয়টি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। দৈনন্দিন নানা গরম গরম ইস্যুর কারণে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের একটি অংশ নিয়ে পূর্ব তিমুরের মতো খ্রিষ্টান রাষ্ট্র বানানোর চক্রান্তের বিষয়টি সেভাবে আলোচনায় আসছে না। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এই প্রসঙ্গটি সামনে এনেছেন।
হঠাৎ করেই সরকারপ্রধান কেন ‘খ্রিষ্টান রাষ্ট্র’ বানানোর অভিযোগ তুললেন- তা নিয়ে জনমনে অবশ্য কৌতূহল কম নেই। যারা সরকারের সব কিছুকেই মন্দ চোখে দেখে তারা মনে করছে, একের পর এক হাটে হাঁড়ি ভাঙার ঘটনায় সরকার বিব্রত। তাই মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য এই নতুন দাওয়াই। তবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জেরে বাংলাদেশের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের পক্ষের গৃহদাহ চরমে উঠেছে। তারা পাল্টাপাল্টি বিবৃতি পর্যন্ত দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, মিয়ানমারের কিছু অংশ, ভারতের মনিপুর ও মিজোরাম মিলিয়ে একটি দেশ গঠনের পরিকল্পনা ১৯৮০-র দশকের সময় থেকেই শুরু হয়েছিল। বর্তমানে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের কারণে এ প্রক্রিয়া ফের শুরু করেছে একটি মহল। তবে এই প্রক্রিয়ায় একটি খ্রিষ্টান রাষ্ট্র বানানোর ধারণা বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করেন তারা।
মেজর পদমর্যাদার একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক একটি দৈনিক পত্রিকাকে বলেছেন, নিঃসন্দেহই একটি মুভমেন্ট আছে দেখেই প্রধানমন্ত্রী মন্তব্যটি করেছেন। এই মুভমেন্ট আগে থেকেই ছিল। এই চক্রান্তে শুধু বাংলাদেশ নয়; মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের মনিপুর এবং মিজোরামও জুড়ে দেওয়ার অপচেষ্টা রয়েছে। সেক্ষেত্রে ভারত কি তার দুই প্রদেশ মনিপুর এবং মিজোরামকে নতুন দেশের জন্য ছেড়ে দেবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সীমান্ত অঞ্চলজুড়েই খ্রিষ্টান দেশ গঠনের মুভমেন্ট আছে। তবে নতুন দেশের সীমান্ত কী হবে তা তো এখন বলা যাবে না। এখনো সব কিছু পরিষ্কার নয়। একটি মুভমেন্ট আছে- শুধু এটুকুই জেনে রাখেন।
এটা অনেকেরই জানা যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র পূর্ব তিমুর। ইন্দোনেশিয়ার তিমুর দ্বীপের পূর্বাঞ্চলীয় এই অংশটি ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগালের ঔপনিবেশ ছিল। সে সময় এর নাম ছিল পর্তুগিজ তিমুর। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে তারা স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তবে এর ৯ দিনের মধ্যেই ইন্দোনেশিয়া পূর্ব তিমুর দখল করে নেয়। ইন্দোনেশিয়ার ২৭তম প্রদেশ ঘোষণা করা হয় একে। এরপর কয়েক দশক ধরে ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনীর সঙ্গে পূর্ব তিমুরের বিচ্ছিন্নতাবাদী কয়েকটি গ্রুপের লড়াই চলে।
২০০২ সালের ২০ মে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে পূর্ব তিমুর। মূলত জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানেই স্বাধীনতা লাভ করে দেশটি। পূর্ব তিমুরে অবস্থান করছে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী। এশিয়ার দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি পূর্ব তিমুর। বিদেশি সহায়তার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। খরাপ্রবণ দেশটির অবকাঠামো খুব একটা উন্নত নয়। উপকূল থেকে কিছুটা দূরে তেল ও গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়ায় দেখা দিয়েছে নতুন সম্ভাবনা।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের একটি অংশ নিয়ে পূর্ব তিমুরের মতো খ্রিষ্টান দেশ বানানোর চক্রান্ত চলছে বলে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না জানতে চেয়েছেন, কে বা কারা এমন প্রস্তাব দিয়েছে? গত ২৫ মে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক কর্মসূচিতে মান্না বলেন, দেশের এবং সরকারের অবস্থা যখন খারাপ তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেন্ট মার্টিনের মতো রাখাইন আর পার্বত্য চট্টগ্রাম মিলিয়ে খ্রিষ্টান রাজ্য বানানোর প্রস্তাব পেয়েছেন বলে নতুন কাহিনি শুরু করেছেন। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী আগেও বেশ কয়েকবার এসব কথা বলেছেন। এবার একটু স্পষ্ট করছেন। তার কাছে নিশ্চয়ই তথ্য আছে, নাহলে তো বলতেন না।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের যে অংশ ভেঙে খ্রিষ্টান দেশে সংযুক্ত করার কথা বলা হচ্ছে- মূলত সেখানে খ্রিষ্টান জনজাতি প্রায় নেই বললেই চলে। মিয়ানমার, ভারতের মিজোরাম ও মনিপুরে খ্রিষ্টান জনসংখ্যা বেশি। কিন্তু ভারত কী চাইবে তার প্রদেশ দুটো অন্যের হাতে ছেড়ে দিতে। বিশ্লেষকরা বলছেন, আলাদা খ্রিষ্টান রাষ্ট্র গঠনের নামে মূলত মিয়ানমারে গণ্ডগোল দীর্ঘস্থায়ী করিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ঠেকানো অন্যতম একটি কারণ হতে পারে।
পাশাপাশি মিয়ানমারে এখন যেসব বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী রয়েছে তারা চীনের স্বার্থে কাজ করছে। তারা মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে না থেকে চীনের সহায়তায় দেশটিতে ফেডারেল সরকার গঠন করতে চায়। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে থাইল্যান্ডের একটি প্রভাব আছে বলে জানা গেছে। থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনওয়াত্রার সঙ্গে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা একটি বৈঠক করেছেন। পরে থাকসিন সিনওয়াত্রার নেতৃত্বে মালয়েশিয়ায় আরেকটি বৈঠক হয়। যেখানে আসিয়ানের বর্তমান চেয়ারম্যান লাউস, আগামীর চেয়ারম্যান ইন্দোনেশিয়া এবং সঙ্গে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিরা বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন।
একজন কূটনৈতিক বিশ্লেষকের বরাত দিয়ে একটি পত্রিকা লিখেছে, সেই বৈঠকের পরই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে যেটুকু গতি ছিল তাও হারিয়ে যায়। প্রত্যাবাসনের কথা জানতে চাইলে উল্টো বাংলাদেশকে বলা হয়, মিয়ানমার টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে আর তোমরা (বাংলাদেশ) রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কথা বলছ। বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ভারতের মতো প্রাদেশিক সরকারের মাধ্যমে মিয়ানমারের রাষ্ট্র পরিচালনার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
অর্থাৎ গণতন্ত্রের মোড়কে ফেডারেল সরকার থাকবে। এই সরকারে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে মিয়ানমারের নেত্রী অং সাং সুচির দলও যুক্ত থাকবে। তিনি বলেন, এই নিয়ে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের ওপরে চীনও চাপ দিচ্ছে। আর্মিকে সরিয়ে সেখানে গণতান্ত্রিক সরকার বসাতে চায় তারা এবং এই সরকারের নাম হবে ফেডারেল সরকার। এই কারণে আরাকানে ভারতীয় প্রজেক্টেরও আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। তবে যারা অস্ত্র উঠিয়েছে তারা মিয়ানমারে স্বাধীনতা চায় না, স্বায়ত্তশাসন চায়।
কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, খ্রিষ্টান জনজাতি ভারতের মনিপুর ও মিজোরামে বেশি। ভারত কী চাইবে তাদের কোলঘেঁষে আরেকটি খ্রিষ্টান রাষ্ট্র হোক। সব মিলিয়ে কী হবে এবং কী হচ্ছে- গোটা বিষয়ই বাংলাদেশের কড়া নজর রাখা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
গত ২৩ মে গণভবনে ১৪ দলের বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে বাংলাদেশের একটা অংশ নিয়ে খ্রিষ্টান রাষ্ট্র বানানোর চক্রান্ত চলছে বলে জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন বলেছিলেন, ফিলিস্তিনের মতো বাংলাদেশের একটা অংশ চট্টগ্রাম, মিয়ানমার নিয়ে খ্রিষ্টান স্টেট (রাষ্ট্র) বানাবে। বে অফ বেঙ্গলে (বঙ্গোপসাগরে) একটা ঘাঁটি করবে। তার কারণ হচ্ছে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে প্রাচীন কাল থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য চলে, আর এই জায়গাটাতে কোনো কন্ট্রোভার্সি নেই, কারও কোনো দ্বন্দ্ব নেই।
বঙ্গোপসাগর ভারত মহাসাগরের ভেতরেই একটি উপসাগর, এটা প্রাচীন কাল থেকেই ব্যবহার হচ্ছে। এই জায়গাটার ওপর অনেকের নজর। এটা আমি হতে দিচ্ছি না, এটাও আমার একটা অপরাধ। যদিও একটা দেশকে দেখানো হয়, কিন্তু আমি তো জানি তারা কোথায় কোথায় হামলা চালাবে, সেটা তো আমি জানি। সে কারণে আমাদের কিছু সমস্যায় পড়তে হচ্ছে, পড়তে হবে জানি, কিন্তু আমি সেটা পাত্তা দেই না। দেশের মানুষ আমার শক্তি, মানুষ যদি ঠিক থাকে তাহলে আমরা আছি। দেশটার যে উন্নতি হচ্ছে সেটাও অনেকের পছন্দ নয়। সংক্ষেপে অনেক কিছুই ইঙ্গিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তার কাছে সব বিষয়ে তথ্য আছে। তবে মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য বা নজর সরানোর জন্য এই তথ্য প্রকাশ করেছেন, এটা আমি অন্তত মনে করি না।
ভারতের নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি যদি তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে, রাশিয়া-চীন সম্পর্কে যদি উষ্ণতা বাড়তেই থাকে এবং সব প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে ট্রাম যদি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হন, তাহলে বিশ্ব রাজনীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশে কী ঘটবে, ভবিষ্যৎ বিশ্বরাজনীতিতে বাংলাদেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটা নিঃসন্দেহে একটি দেখার বিষয় হবে।
০৩ জুন, ২০২৪
লেখক : রাজনীতিবিদ, কলামিস্ট ও চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ