জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল কর ফাঁকি প্রতিরোধ ও অর্থ পাচার ঠেকাতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লেনদেন করে এরূপ ৯২১টি প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে।এনবিআরের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
এনবিআরের ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল কোম্পানিগুলোর তালিকা প্রস্তুত করে চলতি মাস থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক লেনদেনের তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে।
জানা যায়, এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূইঁয়ার নেতৃত্বে ৯ম বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে অডিট কাজ শেষ করে প্রতিষ্ঠানগুলোর পৃথক ট্যাক্স প্রোফাইল তৈরি করা হবে।
এ বিষয়ে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, চেয়ারম্যানের নির্দেশ পেয়ে তথ্য সংগ্রহ করার কাজ শুরু হয়েছে। ৯২১টি প্রতিষ্ঠানকে ধাপে ধাপে নিরীক্ষার আওতায় আনা হবে।
তিনি বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যবসার ধরণ এবং লেনদেনের উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। এরপর প্রতিষ্ঠানের ধরণ অনুসারে প্রশ্নপত্র তৈরি করে কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে উত্তর নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করা হবে।
এনবিআরে অনুষ্ঠিত বোর্ড সভা সূত্রে জানা যায়, ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল এর সমন্বয়ক এই সভায় জানান যে, মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে ইতোমধ্যে ৯২১টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা হতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করে তাদের আন্তর্জাতিক লেনদেন সংগ্রহ করার বিষয়ে চেয়ারম্যান অনুমতি দিয়েছেন।
ফলে আন্তর্জাতিক লেনদেন রয়েছে এরূপ প্রতিষ্ঠানে ট্যাক্স প্রোফাইল তৈরি করা যাবে এবং জানুয়ারি থেকে অডিট কার্যক্রম শুরু করা হবে।
এনবিআর দেশের অভ্যন্তরে কার্যক্রম পরিচালনা করছে এমন বহুজাতিক কোম্পানির আন্তর্জাতিক লেনদেন বিশেষভাবে নিরীক্ষার উদ্দেশ্যে কোম্পানির বিদেশে অবস্থিত মূল কোম্পানি কিংবা অন্য কোম্পানির সঙ্গে লেনদেনের সব তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছে।
এর আগে সম্প্রতি এনবিআরের ট্রান্সফার প্রাইসিং সেলকে পুর্নগঠন করা হয়। সেন্ট্রাল ইন্টিলিজেন্স সেলের (সিআইসি) যুগ্ম মহাপরিচালক মো. শাব্বির আহমদকে ট্রান্সফার প্রাইসিং সেলের সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, বিদেশি কোম্পানিগুলোর শাখা কোম্পানি সুদ, মুনাফা, কোনো সম্পদ কিংবা কোনো পণ্যের মূল্য মূল কোম্পানিতে পাঠায়। এছাড়া পণ্য বা সেবা আমদানির মূল্যও মূল কোম্পানি বা অন্য কোনো কোম্পানিকে পাঠায়। যা ট্রান্সফার প্রাইসিং হিসেবে পরিচিত।
তবে পণ্যের দর কম বা বেশি দেখিয়ে কিংবা মুনাফার অর্থ প্রেরণে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার মাধ্যমে কর ফাঁকির পাশাপাশি অর্থপাচারের অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
অভিযোগ রয়েছে, এর ফলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে থাকে। সাধারণত যে সব দেশে কর হার বেশি সে দেশের প্রতিষ্ঠান থেকে নানা কৌশলে কর হার কম এমন দেশের সহযোগী প্রতিষ্ঠানে অর্থ স্থানান্তর করা হয়।
ফলে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের আয় বাড়ে কিন্তু কর কম দিতে হয়। যা একধরনের অর্থপাচার। এতে প্রাপ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অপেক্ষাকৃত বেশি কর রয়েছে এমন দেশগুলো।
বছরে কমপক্ষে তিন কোটি টাকা আন্তর্জাতিক লেনদেন হয়, এমন ১শ’ থেকে ১২০টি কোম্পানি এনবিআরের কাছে তাদের সব লেনদেনের বিবরণী পাঠায়। যদিও দেশে বহুজাতিক কোম্পানির সংখ্যা প্রায় পৌনে দুইশ’।
প্রাথমিকভাবে এর মধ্য থেকেই সন্দেহজনক লেনদেনকারী বা ‘উচ্চ ঝুঁকিতে’ থাকা কোম্পানির তথ্য যাচাই-বাছাই কার্যক্রম চলমান। যে সব কোম্পানির লেনদেনে ‘সন্দেহ’ তৈরি হবে, সেগুলোতে বিশেষায়িত অডিট কার্যক্রম পরিচালনা করবে বিশেষ সেল।
এ বিষয়ে এনবিআরের প্রাক্তন চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, বেশিরভাগ বহুজাতিক কোম্পানি মূলত আমদানিতে বাড়তি মূল্য দেখানোর মাধ্যমে কর ফাঁকি এবং অর্থপাচার করে। ২ ডলারের পণ্য আমদানিতে হয়ত ১০ ডলার দেখায়। এর বাইরে আরো অনেক উপায়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর একটি অংশ কর ফাঁকি দেয়। এর ফলে বড় অঙ্কের কর ফাঁকি দেওয়া সম্ভব।
বিশ্বব্যাপী ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে কর ফাঁকি ঠেকাতে বেশ আগে থেকেই কার্যক্রম শুরু করা হলেও এই অঞ্চলের দেশগুলো তাতে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। ভারতে ২০০১ সালে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার পর কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৬ সালে। শ্রীলঙ্কায় শুরু হয়েছে ২০০৮ সালে। কিন্তু বাংলাদেশে ২০১২ সালে এ সংক্রান্ত আইন হলেও কার্যক্রম শুরু হতেই দীর্ঘ সময় পার করেছে।
প্রসঙ্গত, বহুজাতিক কোম্পানিসহ আন্তর্জাতিক লেনদেনে স্বচ্ছতা আনার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত কর আদায়ের লক্ষ্যে সরকার ২০১২ সালে ট্রান্সফার প্রাইসিং আইন প্রণয়ন করে। তবে এটি কার্যক্রম শুরু করে ২০১৪ সালে। এ লক্ষ্যে ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল গঠন করা হয়। কিন্তু এখনো পর্যন্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর লেনদেন সংক্রান্ত নথি বিশেষায়িত নিরীক্ষা করা শুরু হয়নি।
এর মূল কারণ হিসেবে বরাবরই এনবিআর লোকবলে ঘাটতি ও কৌশলগত কারণকে দায়ী করে আসছে।