বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, যা কিছুই ঘটুক না কেন, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সম্পন্ন করে আগামী দেড় বছরের মধ্যে যেন নির্বাচন হতে পারে সেজন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সব ধরনের সহায়তা করা হবে।
সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এমনটি জানান।
বিরল এই সাক্ষাৎকারে রয়টার্সকে সেনাপ্রধান জানান, শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। তাছাড়া, তিনি নিজেও সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত করতে চান বলে জানান।
সেনাপ্রধান বলেন, যাই হোক না কেন আমি মুহাম্মদ ইউনূসের পাশে আছি। যাতে তিনি তার মিশন সম্পন্ন করতে পারে।
বিশ্বব্যাপী ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের অগ্রদূত ইউনূস বাংলাদেশে বিচার বিভাগ, পুলিশ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কার কর একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার কয়েক সপ্তাহ আগেই সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পান ওয়াকার-উজ-জামান। তার মতে, এমন পরিস্থিতি থেকে গণতন্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণ করতে এক থেকে দেড় বছর সময় নেওয়া উচিত। এসময় তিনি সবাইকে ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানান।
বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) উভয়ই আগামী তিন মাসের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচন দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছে।
সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জানান, তিনি ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রতি সপ্তাহেই সাক্ষাৎ করেন ও তাদের মধ্যে একটি ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বলেন, আমি নিশ্চিত, আমরা যদি একসঙ্গে কাজ করি, তাহলে ব্যর্থ হওয়ার কোনো কারণ নেই।
বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে এক হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গত জুলাইতে সরকারি চাকরিতে কোটার সংস্কারের দাবিতে এ আন্দোলন শুরু হয়। পরে এটি সরকারবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়।
শেখ হাসিনার পতনের পর আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা রাজধানী ঢাকা এখন অনেকটাই শান্ত। তবে সরকার পতনের পর প্রশাসনের কিছু অংশ এখনো সঠিকভাবে কার্যকর হয়নি। বাংলাদেশের বেশিরভাগ পুলিশ সদস্যই এখনও বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছে। এ জন্য বাংলাদেশে সেনাবাহিনীকে দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তৎপরতা চালাচ্ছে।
৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠিত হয়। স্বাধীন দেশে বিভিন্ন সময় সামরিক শাসন, রাজনীতিতে সামরিক শাসক এরশাদের হস্তক্ষেপ ও ২০০৭ সালে ‘সেনা-সমর্থিত’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর নির্বাচন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। ২০০৮ সালের ওেই নির্বাচনে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। পর্যবেক্ষকদের মতে, বাংলাদেশের সাধারন নির্বাচনের ইতিহাসে ২০০৮ সালের নির্বাচনটি ছিল সর্বশেষ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান বলেছেন, তিনি যে বাহিনীর নেতৃত্ব দেন তারা রাজনৈতিকভাবে হস্তক্ষেপ করবে না। আমি এমন কিছু করবো না, যা আমার বাহিনীর জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমি একজন পেশাদার সৈনিক। আমি আমার বাহিনীকেও পেশাদার রাখতে চাই।
এই সেনা কর্মকর্তা জানান, সরকার পতনের পর সংস্কারের অংশ হিসেবে সেনা সদস্যদের বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগও খতিয়ে দেখা হচ্ছে ও কয়েকজনকে এরই মধ্যে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। তবে এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি তিনি।
ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, যদি কোনো দায়িত্বরত সদস্য দোষী সাব্যস্ত হন, অবশ্যই আমি ব্যবস্থা নেবো। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরাসরি নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলোতে কাজ করার সময় কিছু সামরিক কর্মকর্তা আইন বহির্ভূত বাইরে গিয়ে কাজ করেছেন বলেও স্বীকার করেন তিনি।
সেনাপ্রধান বলেন, সামগ্রিকভাবে সামরিক বাহিনীকে কখনোই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা উচিত নয়। একজন সৈনিককে রাজনীতি করা উচিত নয়।
ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত তখনই রাখা যেতে পারে যখন রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকে। এমন ব্যবস্থায় সশস্ত্র বাহিনীকে সরাসরি রাষ্ট্রপতির অধীনে রাখা যেতে পারে।
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী বর্তমানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে, যা সাধারণত প্রধানমন্ত্রী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সাংবিধানিক সংস্কারের সময় এ বিষয়ে সংশোধন চান ওয়াকার-উজ-জামান।
সূত্র: রয়টার্স