প্রসঙ্গ: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার ও বিচারক নিয়োগ

সম্পাদকীয়

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল

জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের একাংশের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার (অবস্থা দৃষ্টে যেটিকে মনে হচ্ছে শুধু আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিচার)। সরকার বলছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) বিচার করা হবে। যদিও সরকার এখনো আইসিটি আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনী এবং পদ্ধতির বিধিগুলো নিয়ে পরামর্শ করার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে, এরমধ্যেই তারা বিচারের জন্য ট্রাইবুনালে তিন জন বিচারক নিয়োগ দিয়েছেন।

আমরা সেই তিনজন বিচারকের দিকে নজর দিই। আইসিটি চেয়ারম্যান গোলাম মর্তুজা মজুমদার। তিনি অবসরপ্রাপ্ত জেলা আদালতের একজন বিচারক। মাত্র কয় দিন আগে তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। দ্বিতীয় নিয়োগপ্রাপ্ত হলেন মহিতুল হক মো. এনাম চৌধুরী। একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ। তৃতীয়জন হলেন আইনজীবী শফিউল আলম মাহমুদ। উনিও গোলাম মর্তুজা মজুমদারের মতো কয়েক দিন আগে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।

এই নিয়োগগুলো নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে। প্রথমত, বিচারকদের কারোরই কর্মজীবনে কোনো মামলায় আন্তর্জাতিক আইনের নীতি প্রয়োগ করার কোনো অভিজ্ঞতা আছে বলে মনে হয় না। আলোচ্য বিচারের সঙ্গে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং তাকে ঘিরে থাকা জটিল আইন জড়িত। তাই এই অভিজ্ঞতা বিচারকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা বলে মনে হয়।

দ্বিতীয়ত, এই আইসিটির বিচারকদের মধ্যে দুজন হলেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা আদালতের বিচারক। তাঁরা কয়েক বছর ধরে কোনো ধরনের ফৌজদারি মামলা মোকাবিলা করেননি। আন্তর্জাতিক আইনের জটিল বিষয় নিয়ে কাজ করার কথা বাদই দিলাম। গোলাম মর্তুজা মজুমদার অবসর নিয়েছেন ২০১৯ সালে। গত পাঁচ বছর তিনি বিচারকের দায়িত্ব পালন করেননি। এখন আইসিটি চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি হঠাৎ করে আপিল বিভাগের বিচারপতির পদমর্যাদা পেয়েছেন।

তৃতীয়ত, শফিউল আলম মাহমুদ একজন আইনজীবী। তিনি মাত্র ছয় দিন আগে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। বিচারক হওয়ার আর কোনো অভিজ্ঞতা তাঁর নেই।

এ ছাড়া শফিউল আলম মাহমুদ বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ২০১৯ সালে তিনি বিএনপির পক্ষ হয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এটা খুবই আশ্চর্যের বিষয় যে সরকার আইসিটি বিচারক হিসেবে এমন এক ব্যক্তিকে নিয়োগ দিল, যিনি এমন একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য, যারা আওয়ামী লীগের ঘোর বিরোধী। আর অনেক আসামি তো আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত থাকার সম্ভাবনাই বেশি। উনি যদি স্বাধীনভাবে বিচারিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষমও হন, তবু ভুললে চলবে না যে তিনি এখনো বিচারকের দায়িত্ব পালন করেননি। আর তাঁর কাছ থেকে পক্ষপাতের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

চতুর্থত, বাংলাদেশে বহু বছরের অভিজ্ঞ হাইকোর্টের আরও অনেক যোগ্য বিচারক রয়েছেন। সে হিসেবেও, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এমন একটি বিচারের জন্য অপেক্ষাকৃত নিম্ন মর্যাদার বিচারকদের বেছে নেওয়া হয়েছে।

এবং পঞ্চমত, তাঁরা সবাই বাংলাদেশি। এটাও একটা প্রাসঙ্গিক বিষয়। দেশে আওয়ামী লীগবিরোধী আবেগ এখন খুব প্রবল। বাংলাদেশের বিচারকেরা, বিশেষ করে নির্বাচিত ব্যক্তিরা আওয়ামী লীগের কোনো জ্যেষ্ঠ সদস্যকে যথেষ্ট প্রমাণ না থাকলে কি বেকসুর খালাস দিতে পারবেন? এটা খুবই যৌক্তিক একটি প্রশ্ন।

যাঁরা ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের বিচারের একটি ন্যায্য এবং বিশ্বাসযোগ্য প্রক্রিয়া দেখতে চান, তাঁদের জন্য এই নিয়োগগুলো উদ্বেগজনক। এই নিয়োগের ফলে বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে ভবিষ্যতে যে প্রশ্ন উঠবে সেটি আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি।

শেয়ার করুন