সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে জনপ্রিয় মানুষের শেষ ঠিকানা হিসেবে রাজনীতির চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পেশা আর নেই। যত জনপ্রিয়ই হোন, রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর তাঁর আগের অবস্থান ধরে রাখতে না পারার বিষয়টি প্রায় স্বতঃসিদ্ধ বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। শুধু এ দেশে নয়, সারা দুনিয়ার চিত্র প্রায় একই। তবে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে তা বলতে গেলে অনিবার্য। এখানে সমাজের শিকড় থেকে উঠে আসা জনবান্ধব ব্যক্তিও রাজনীতির গতানুগতিক বৃত্তে গিয়ে অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে অজনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তার দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে গড়ে তোলা ভাবমূর্তি চোখের পলকে বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। এর সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে লাগসই উদাহরণ সম্ভবত অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর।
কেন এমন ঘটে? কারণ মানুষের জনপ্রিয়তার পেছনের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো সততা। আর বাংলাদেশে রাজনৈতিক কাঠামো এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, অসততা না করে নিদেনপক্ষে প্রশ্রয় না দিয়ে ক্ষমতা, পদ-পদবি, ক্রয়-বিক্রয়ের রাজনীতিতে টিকে থাকা সবচেয়ে দুরূহ কাজ। ফলে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে জনপ্রিয় ব্যক্তি রাজনীতির মাঠের নতুন কুশীলব হয়ে শুরুতে দোটানায় পড়ে যান। মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসাকে শিগগিরই অবজ্ঞা করার আগে তিনি দারুণ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকেন। কোন দিকে যাবেন তিনি? সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষার দিকে, না অঢেল অর্থ আর ক্ষমতার চেয়ারের দিকে? তখনই তাঁকে এক ভয়ংকর দোদুল্যমানতায় পেয়ে বসে। এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে তাঁকে চিরতরে হারিয়ে যেতে হয়। আসাদুজ্জামান নূরের ক্ষেত্রে কি সেটাই ঘটেছিল?
২.
১৯৫২ সালের নভেম্বর মাসে ইসরায়েলের প্রথম প্রেসিডেন্ট চেম ওয়েজমানের মৃত্যু হয়। দেশটির ইহুদি জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তখনকার পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনকে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হওয়ার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব পাঠানো হয়। দূতাবাসের মাধ্যমে এমন প্রস্তাব পেয়ে আইনস্টাইন প্রথমে বিস্মিত হলেও আনন্দিত হয়েছিলেন। যদিও শারীরিক অবস্থা ও বার্ধক্যজনিত কারণ দেখিয়ে তিনি সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। পাশাপাশি জানিয়ে দিয়েছিলেন, রাজনীতির চেয়ে সমীকরণেই তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বলেছিলেন: ‘পলিটিকস’ ফর দ্য টাইমবিয়িং; বাট ‘ইকুয়েশন’ ফর ইটারনিটি।
সেদিন আলবার্ট আইনস্টাইন প্রেসিডেন্টের পদ অলংকৃত করলে নিজের ও ইসরায়েলের ইতিহাস হয়তো অন্য রকম হতে পারত। জীবনীতে বিতর্কিত অধ্যায় রচিত হতে পারত। মৃত্যুর ৬০ বছর পরও বিশ্বব্যাপী আলবার্ট আইনস্টাইনের জনপ্রিয়তা কমেনি; এমনকি ইসরায়েলেও তিনি সমান জনপ্রিয়; সেই চিত্র আজ ভিন্ন হতে পারত।
৩.
সংগীতজ্ঞ, সুরস্রষ্টা ও শিল্পী ভূপেন হাজারিকা বাংলা, হিন্দি, অসমিয়া ভাষায় গান গেয়ে জীবদ্দশায় উপমহাদেশজুড়ে কিংবদন্তি হয়েছিলেন। ভারতের সব গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার তাঁর হাতে এসেছিল। ২০০৬ সালের বিবিসি শ্রোতা জরিপে তাঁর গান– ‘মানুষ মানুষের জন্যে/ জীবন জীবনের জন্যে’ সেরা ২০ বাংলা গানের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিল। সংগীত সাধনার বাইরেও বাম রাজনীতি, কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন জীবনাচার, মানবিকতার ফেরিওয়ালা হিসেবে তিনি দুনিয়াজুড়ে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। কিন্তু শেষ জীবনে এসে বিজেপির রাজনীতিতে যোগ দিয়ে লোকসভায় নির্বাচন করতে গিয়ে সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা থেকে ইন্দ্রপতন ঘটেছিল। ভূপেন হাজারিকার প্রায় আট দশকের জীবন সাধনা নিয়ে প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেখা দিয়েছিল। রাজনীতিই তাঁর জীবনসায়াহ্নকালকে অস্বস্তিকর
করে তুলেছিল।
৪.
অভিনয় ও আবৃত্তিতে আসাদুজ্জামান নূরের সমান জনপ্রিয়তা এর আগে খুব বেশি অভিনেতা অর্জন করতে পারেননি। মঞ্চ, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র– যেখানেই পা ফেলেছেন, তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়েছে সাফল্য। অনেক সফল সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বৈষয়িক জীবনে সফল হন না; আসাদুজ্জামান নূর সেখানেও সফল ছিলেন। ক্ষমতার রাজনীতি কি তাঁর জন্য খুব অপরিহার্য কিছু ছিল? তিনি অনায়াসে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করে এবং ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা নিয়ে দাপটের সঙ্গে টিকে থাকতে পারতেন। রাজনীতির নোংরা কালিমা তাঁকে কখনও স্পর্শ করতে পারত না। তিনি প্রজন্ম-পরম্পরায় ‘নূরলদীন’ বা ‘বাকের ভাই’ হয়েই থাকতে পারতেন। অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূরের নেতা হয়ে যাওয়ার বিষয়টি রাজনীতির বাইরে থাকা সংস্কৃতিমনস্ক মানুষকেও কষ্ট দিয়েছিল। আবার এখন তাঁকে যে কারাগারে থাকতে হচ্ছে, জনতার রোষের মুখে পড়তে হচ্ছে; সেটাও কাউকে কাউকে কষ্ট
দিচ্ছে বৈকি।
৫.
অন্য ধরনের জনপ্রিয়তার কথাও বলা যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে রাস্তাঘাট, দুর্নীতি, অনিয়ম, অসংগতি জনসমক্ষে তুলে ধরে অকল্পনীয় জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। সুদর্শন ও তরুণ এই আইনজীবী দেশের বিভিন্ন এলাকার পাশাপাশি নিজ এলাকার মানুষের হৃদয়েও শক্ত আসন গেড়ে বসেছিলেন। ভাবলে বিস্ময় জাগে, ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন না পেয়েও তিনি কীভাবে একজন প্রতিমন্ত্রীকে বিপুল ভোটে হারিয়ে দিয়েছিলেন! সেই আসনে ভোট কারচুপির সুযোগ ছিল মন্ত্রীরই; সুমনের নয়। এখন ব্যারিস্টার সুমন কারাগারে। অথচ দলীয় রাজনীতিতে না জড়িয়ে নিজের আইন পেশা এবং সামাজিক দায়দায়িত্ব নিয়ে তুমুল জনপ্রিয়তার দীর্ঘ জীবন পেতে পারতেন তিনি।
রাজনীতি আসলে সর্বগ্রাসী। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া, আইন, শিক্ষা, বিজ্ঞান– অন্য কোনো ক্ষেত্রের জনপ্রিয়তা সেখানে পার পায় না। সবকিছু গিলে ফেলে। অতীতেও অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে; কিন্তু আসাদুজ্জামান নূর বা ব্যারিস্টার সুমনের পরিণতি দেখে বর্তমান ও ভবিষ্যতের জনপ্রিয় ব্যক্তিরা রাজনীতিতে যাওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় চিন্তা করতে পারেন, যদি বর্তমান রাজনৈতিক কাঠামো ও চর্চার পরিবর্তন না হয়।
হোসেন আবদুল মান্নান: কলাম লেখক;
সাবেক সচিব