ইরানকে যে কারণে এত ভয় করেন ট্রাম্প

মত ও পথ ডেস্ক

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফাইল ছবি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানকে ব্যাপক ভয় করেন। ট্রাম্পের আমলে ইরাকে মার্কিন হামলায় নিহত হন ইরানি কমান্ডার কাসেম সোলাইমানি। তার পর থেকেই ট্রাম্প আশঙ্কা করে আসছেন, ইরান যেকোনোভাবে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করতে পারে। এমনটাই দাবি করেছেন, তাঁকে নিয়ে লেখা ‘রিভেঞ্জ: দ্য ইনসাইড স্টোরি অব ট্রাম্পস রিটার্ন টু পাওয়ার’ বইয়ের লেখক অ্যালেক্স আইজেনস্ট্যাড।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম এক্সিওসে আইজেনস্ট্যাড লিখেছেন, ২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারের সময় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। এটা সবাই জানেন। আইজেনস্ট্যাড দাবি করেছেন, এই হামলার পেছনে ইরানের হাত ছিল। জনসমক্ষে ইরানের হুমকি সবাই যতটা ধারণা করে বাস্তবে এই হুমকি আরও বেশি ও গুরুতর। এই হুমকি মোকাবিলায় ট্রাম্পের দল বেশ কিছু ব্যতিক্রমী সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছিল। যার মধ্যে একটি ছিল ছদ্মবেশী বিমান ব্যবহার করা, যাতে সম্ভাব্য হামলা প্রতিহত করা যায়।

আইজেনস্ট্যাড ‘রিভেঞ্জ: দ্য ইনসাইড স্টোরি অব ট্রাম্পস রিটার্ন টু পাওয়ার’ বইতে মার্কিন কর্তৃপক্ষ ইরানের সম্ভাব্য হামলা নিয়ে কতটা উদ্বিগ্ন ছিল এবং এই বিষয়টি ট্রাম্পকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

ইরানি হুমকি যে এখনো ট্রাম্পের মাথায় ঘুরছে তার ইঙ্গিত মেলে গত সপ্তাহে তাঁর এক বক্তব্য থেকে। ট্রাম্প বলেন, যদি ইরানি গোয়েন্দারা তাঁকে ‘হত্যার চেষ্টা করে’, তবে তিনি তাঁর প্রশাসনকে ইরানকে ‘সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস’ করার নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন।

পরে অবশ্য ট্রাম্প তাঁর এই বক্তব্য খানিকটা সংশোধন করে বলেন, তিনি ইরানের সঙ্গে একটি ‘নিশ্চিত পারমাণবিক শান্তিচুক্তি’ চান। আইজেনস্ট্যাড দাবি করেন, ইরান ২০২০ সাল থেকেই ট্রাম্পকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। কারণ, সে বছরই ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তাঁর নির্দেশে এক বিমান হামলায় ইরানের শীর্ষ সামরিক নেতা কাসেম সোলাইমানি নিহত হন।

আইজেনস্ট্যাড তাঁর বইতে বলেছেন, ‘মার্কিন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো গত বছর ট্রাম্পকে সতর্ক করেছিল যে ইরান যুক্তরাষ্ট্রে তাদের এজেন্ট মোতায়েন করেছে। এসব এজেন্টের কাছে ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রও আছে।’

ট্রাম্পের দল আশঙ্কা করেছিল যে ইরানিরা তাঁর ব্যক্তিগত বিমানে হামলা চালাতে পারে। গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর ফ্লোরিডার ওয়েস্ট পাম বিচে ট্রাম্পের গলফ কোর্সে ট্রাম্পের দিকে গুলি চালানো হলে এই উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়। অবশ্য, আইজেনস্ট্যাড স্বীকার করে নিয়েছেন, এই ঘটনায় ইরানের জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ নেই। একইভাবে এই ঘটনার ঠিক দুই মাস আগে পেনসিলভানিয়ায় ট্রাম্পের ওপর হামলার ঘটনায়ও ইরানের জড়িত থাকার প্রমাণ নেই। এই হামলায় অবশ্য ট্রাম্পের কানের একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

তবে ফ্লোরিডার ঘটনার পরপরই ট্রাম্পের নিরাপত্তা দল এতটাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে যে তারা ট্রাম্পকে একটি ছদ্মবেশী বিমানে ভ্রমণের ব্যবস্থা করে। এই বিমানটি ছিল তাঁর বন্ধু ও রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী স্টিভ উইটকফের। এই উইটকফ বর্তমানে ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত।

এরপর ট্রাম্পের ব্যক্তিগত বিমান ‘ট্রাম্প ফোর্স ওয়ানে’ তাঁর প্রচারাভিযানের বেশির ভাগ স্টাফদের তোলা হতো। আর ট্রাম্প উঠতেন উইটকফের বিমানে। এই বিষয়টি ট্রাম্পের অনেক সহযোগীকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। কারণ, তাঁরা ভয় পাচ্ছিলেন, যদি ওই বিমানে হামলা হয়, তবে তাঁরা মারা যেতে পারেন।

প্রচারাভিযানের দুই প্রধান ব্যবস্থাপক সুজি ওয়াইলস (যিনি এখন হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ) ও ক্রিস লাসিভিটা নিরাপত্তার স্বার্থে আলাদা হয়ে যান। ওয়াইলস ট্রাম্পের সঙ্গে উইটকফের বিমানে ওঠেন, আর লাসিভিটা থাকেন ট্রাম্প ফোর্স ওয়ানে।

অনেকেই এ বিষয়ে অবগত ছিলেন না। কিছু সহকারী বিমান উড্ডয়নের ঠিক আগে বুঝতে পারেন, ট্রাম্পের নির্ধারিত জানালার আসনটি খালি পড়ে আছে। লাসিভিটা তখন সবাইকে বলেন, ‘বস আজ আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন না। তাঁকে অন্য এক বিমানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এটি ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার একটি পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ মাত্র।’

প্রচারাভিযানের শীর্ষ নেতারা আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন, ট্রাম্পের দল ইরানি হামলার টার্গেট হচ্ছে না। কিন্তু যেহেতু শত্রুর কাছে ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র থাকার শঙ্কা ছিল, অনেকেই ভাবতে বাধ্য হন, তাহলে তাদের কেন এই বিমানে তোলা হলো?

সেই ফ্লাইটের অভিজ্ঞতা ছিল যেন এক বিভীষিকা। সেখানে অনেক সহকর্মী একে অন্যের সঙ্গে রসিকতা করছিলেন, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে চরম আতঙ্কিত ছিলেন। পরে ট্রাম্পের তিন সহযোগী আইজেনস্ট্যাডকে বলেন, ‘ব্যাপারটা ছিল ভয়ংকর, আমরা বুঝতে পারছিলাম, এটা সত্যিই গুরুতর ঘটনা।’

ট্রাম্পের প্রচারাভিযানের মধ্যে ওই ফ্লাইটের কথা পরে ‘ঘোস্ট ফ্লাইট’ নামে পরিচিতি পায়। সেদিন সিক্রেট সার্ভিস একটি ছদ্মবেশী গাড়ি শোভাযাত্রাও চালু করেছিল। এর একটিতে ছিলেন ট্রাম্প, অন্যটিতে তাঁর সহকর্মীরা। এমন আরও কিছু আতঙ্কজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় ট্রাম্পের প্রচার দলকে।

১৮ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডে এক সমাবেশের পর সিক্রেট সার্ভিস ট্রাম্পের প্রচারাভিযানের নেতাদের সতর্ক করে দেয়, তারা গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছে, ট্রাম্পের গাড়িবহরে হামলা চালানোর পরিকল্পনা থাকতে পারে। লাসিভিটা তখন ঠাট্টার সুরে ট্রাম্পের সোশ্যাল মিডিয়া প্রধান ড্যান স্কাভিনোকে বলেন, ‘গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে ছবি তুলতে যেও না। কারণ, তুমি তখন একেবারে টার্গেট হয়ে যাবে।’

পরের সপ্তাহে পেনসিলভানিয়ার এক সফরে ট্রাম্পের গাড়িবহর লক্ষ্য করে একটি ড্রোন উড়তে দেখা যায়। সিক্রেট সার্ভিসের কর্মকর্তারা গাড়ির ছাদ খুলে একটি তড়িৎ চুম্বকীয় বন্দুক দিয়ে ড্রোনটি নামিয়ে ফেলে।

ট্রাম্পের প্রচারাভিযানের সদস্যরা জানান, ট্রাম্প ইরানি হুমকি নিয়ে জনসমক্ষে যতটা হালকাভাবে কথা বলতেন, বাস্তবে তিনি এর চেয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন। সমাবেশে তিনি প্রায়ই সোলাইমানিকে হত্যার বিষয়ে গর্বভরে বলতেন। কিন্তু যখন ইরানের হুমকি প্রকট হয়ে ওঠে, তখন সহকারীরা লক্ষ্য করেন, ‘তিনি এই বিষয়ে কম কথা বলতে শুরু করেছেন।’

ব্যক্তিগতভাবে, ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারের সমাবেশগুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে বেশি চিন্তা করতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি ভাবতে থাকেন, ‘ভোটাররা কি চার বছর ধরে এই ধরনের হত্যাচেষ্টার শঙ্কা সহ্য করতে চাইবে?’

জনগণ সহ্য করবে কি না—তাই এখন দেখার বিষয়। তবে, আইজেনস্ট্যাডের বক্তব্য যদি সঠিক হয়, তবে এটি স্পষ্ট যে ট্রাম্প ইরানের ভয়ে ব্যাপকভাবে ভীত। আর যেহেতু তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই গেছেন, আগামী চার বছর মার্কিন জনগণকে ট্রাম্পের হত্যাচেষ্টার শিকার হওয়ার যে শঙ্কা সেটি মেনে নিতেই হবে।

শেয়ার করুন