ইংরেজি বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ ১ জানুয়ারিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যে বই তুলে দেয় সরকার। ২০১০ সাল থেকে সরকার প্রতি শিক্ষাবর্ষের শুরুর দিনেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক তুলে দিয়ে আসছে। কিন্তু এ বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সব শিক্ষার্থীর হাতে পাঠ্যবই তুলে দেওয়া সম্ভব হয়নি।
শিক্ষাবর্ষ শুরু হওয়ার প্রায় দুই মাস হতে চলল, কিন্তু দেশের অনেক শিক্ষার্থী এখনো সব পাঠ্যবই হাতে পায়নি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, এখনো প্রায় ৭ কোটি বই ছাপা হওয়া বাকি, যার অধিকাংশই মাধ্যমিক পর্যায়ের।
সরকার পরিবর্তন, শিক্ষাক্রম পরিবর্তন, পাঠ্যবই পরিমার্জনসহ কিছু সমস্যার কারণে এবার শিক্ষা বিভাগ থেকে বলা হয়েছিল, বই পেতে কিছুটা দেরি হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এই দেরি অনন্ত অপেক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছাপার যে পরিস্থিতি, তাতে আগামী এপ্রিল মাসেও শিক্ষার্থীরা সব বই পাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মাঝে সব পাঠ্যবই বিতরণ কবে নাগাদ সম্পন্ন হবে, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন খোদ শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
বই দিতে যত দেরি হচ্ছে, পড়াশোনাও তত ব্যাহত হচ্ছে। অভিভাবকদের উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে, কারণ পাঠ্যবই ছাড়া শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগী করা কঠিন হয়ে পড়ছে। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছায়নি, সেখানে শিক্ষকেরা এনসিটিবির ওয়েবসাইট থেকে বইয়ের পিডিএফ সংস্করণ ডাউনলোড করে পড়াচ্ছেন। তবে সব শিক্ষার্থীর হাতে পিডিএফ সংস্করণ নেই। ফলে যেসব বিষয়ের বই পৌঁছায়নি, সেসব বিষয়ে পড়াশোনা তেমন একটা হচ্ছে না। বিশেষ করে গ্রামের বিদ্যালয়গুলোতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পাঠদান হচ্ছে না বললেই চলে। এভাবে জোড়াতালি দিয়ে স্কুলে পাঠদান চলে না।
বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকেরা জানিয়েছেন, এখন মাধ্যমিকের দুটি পরীক্ষা ষাণ্মাসিক ও বাৎসরিক। ষাণ্মাসিক হয় জুনে। প্রাথমিকের তিনটি পরীক্ষা হয়। তাদের প্রথম পরীক্ষা এপ্রিলে। তার মানে এবার শিক্ষার্থীদের প্রথম পরীক্ষায় বসতে হবে বই ছাড়া।
বই সরবরাহ কেন এত বিলম্বিত হচ্ছে, এ ব্যাপারে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ভাষ্য, বই ছাপানো এমনিতেই একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তার ওপর এ বছর পাঠ্য বিষয় পুরোপুরি বদলে ফেলা হয়েছে। নতুন পাঠ্য বিষয় লেখা, পরিমার্জন, সম্পাদনা, অনুমোদন করতে অনেকটা সময় চলে যায়। এরপর টেন্ডার আহ্বান, সেগুলো যাচাই-বাছাই, কার্যাদেশ দেওয়া ইত্যাদি প্রক্রিয়াগত কারণে আরও সময় ব্যয় হয়। এর সঙ্গে আছে কাগজ ও প্রেস সংকট।
ছাপার পর বই নির্ধারিত মান অনুযায়ী হয়েছে কি না, তা যাচাই করে সরবরাহের আদেশ দেওয়া হয়। ফলে ছাপা হলেও সঙ্গে সঙ্গে তা পাঠানো যায় না, একটু সময় লাগে। আবার ছাপার পর তা বাঁধাইয়ের কাজেও দেরি হয়। সব মিলিয়ে নির্ধারিত সময়ে বই সরবরাহ করতে সমস্যা হয়েছে।
এ কথা ঠিক যে, এ বছর দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বই সরবরাহে বিঘ্ন ঘটেছে। তবে সরকারের অগ্রাধিকার নির্ধারণ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কেননা, সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে আগস্ট মাসে। এরপর সাত মাসেও বইয়ের ব্যবস্থা করতে না পারাটা একধরনের গাফিলতি। জানুয়ারিতে বই বিতরণ করা হবে, এটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়, এনসিটিবিসহ সংশ্লিষ্ট সবাই জানেন। বিষয়টিকে এক নম্বর অগ্রাধিকারের তালিকায় রেখে আগস্টের মাঝামাঝি থেকে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লে এই সংকট সৃষ্টি হতো না বলেই শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
আমাদের দেশের শাসকদের কাছে শিক্ষা কখনোই অগ্রাধিকারের তালিকায় স্থান পায়নি। শিক্ষাকে সব সময়ই গৌণ, অনেক ক্ষেত্রে তুচ্ছ হিসেবে দেখা হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা যথাযথভাবে লেখাপড়া করতে পারছে কি না, তা নিয়ে কিছুমাত্র মাথাব্যথার লক্ষণ দেখা যায় না। শিক্ষার প্রতি এই ঔদাসীন্যের সবচেয়ে বড় প্রমাণ মিলেছিল করোনা মহামারির দিনগুলোতে, যখন গৃহবন্দী শিশু-কিশোরদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সাহায্য করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ বাতলে দেওয়া যায়নি। করোনার সময় প্রায় তিন বছর লেখাপড়া হয়নি। এরপর দুই বছর নতুন কারিকুলাম ছিল। সে সময় আক্ষরিক অর্থে পড়ালেখা ছিল না। প্র্যাকটিক্যাল হচ্ছিল। এবার আবার নতুন বই পাচ্ছে বছরের তিন-চার মাস পর। তাহলে লেখাপড়া হবে কীভাবে? কেবল করোনাকালে নয়, সাধারণভাবেই এ দেশে সরকারি কর্মকাণ্ডে শিক্ষার প্রতি খুব একটা মনোযোগ দেখা যায় না। কারণে-অকারণে স্কুল ছুটি ঘোষণা করা, প্রতিবছর পাঠ্যক্রম বদল এবং পাঠ্যক্রম, প্রশ্ন, পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে প্রতিনিয়ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ইত্যাদি উদ্যোগ শিক্ষাকে দিগ্ভ্রান্ত করে তুলেছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভেঙে পড়া অবকাঠামোর কথা তো বলাই বাহুল্য। যথেষ্ট শিক্ষক নেই, ক্লাসরুম নেই, শিক্ষকদের শিক্ষাবহির্ভূত নানা কাজে লাগানো চলছে দীর্ঘদিন ধরে। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেহাল দশার কারণে ইতিমধ্যেই মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত পরিবার সন্তানদের বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে নিয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে পড়াশোনা আরও ব্যাহত হলে সরকারি স্কুলগুলোতে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা আরও কমবে এবং আরও বহু স্কুল বন্ধ হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হবে।
বিভিন্ন সমীক্ষা প্রতিবেদনে শিক্ষাসম্পর্কিত বিভিন্ন উদ্বেগজনক সংবাদই পাওয়া যায়। ছাত্রছাত্রীদের একটি বড় অংশ প্রাথমিক শিক্ষার বনিয়াদি সামর্থ্যটুকুও অর্জন করছে না। উচ্চশিক্ষার অবস্থা তো আরও করুণ। জাতীয় শিক্ষানীতির বিবিধ আশ্চর্য সংশোধনে ও প্রয়োগে উচ্চশিক্ষার অঙ্গনে যে কত রকমের পঙ্কিল আবর্ত তৈরি করা হয়েছে, তা গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে না। কিছু তথ্য ও সমীক্ষায় কেবল সেই কৃষ্ণশৈলের চূড়াটুকু দৃশ্যমান। তেমনই কিছু তথ্য বলছে—দেশের অগ্রগণ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষকদের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। ওদিকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্লাসমুখী হচ্ছে না। তারা এখন ক্লাস করার চেয়ে অলীক সব দাবিদাওয়া আদায়ের মিছিলে অংশ নিতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে।
শিক্ষা নিয়ে সরকারের উদাসীনতা অত্যন্ত ক্ষতিকর। কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে চাইলে তার শিক্ষাব্যবস্থাকে ভেঙে দিতে হয়। শিক্ষকদের অবহেলা করে তাদের শেখানোর ইচ্ছাকে নষ্ট করে দিতে হয়। আমাদের দেশে যেন তা-ই চলছে। পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই নৈরাজ্যমুখী। উদ্বেগ সবখানে। প্রাথমিক শিক্ষাই হলো সব শিক্ষার ভিত্তি। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি হলো—প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণি মিলিয়ে দেশের প্রায় ৫৬ লাখ শিশু বিদ্যালয়ে যায় না। ঝরে পড়ার হারও আরও অনেক বেশি। তার ওপর কোচিং-বাণিজ্য ও প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানাবিধ কারণে সংখ্যাধিক শিশু ও শিক্ষার্থীরা প্রতিভা বিকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত ও অবহেলিত হচ্ছে।
শিক্ষা প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু শিক্ষাকে অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার কোনো উদ্যোগ সরকারিভাবে নেওয়া হচ্ছে না। বরং শিক্ষায় একধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। শিক্ষা খাতের বরাদ্দ সিংহভাগ চলে যায় ক্যাডেটসহ নামীদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। সেখানে একটা বিশেষ শ্রেণি লেখাপড়ার সুযোগ পায়। দেশে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি অনেক দিনের। কিন্তু সেই দাবিকে উপেক্ষা করে দেশে প্রাইভেট পাবলিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দামি বিলাসবহুল ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল বা কলেজ এবং সাধারণ স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাসহ নানা ধরনের শিক্ষার ব্যবস্থা বহাল রাখা হয়েছে। এতে ধনী ও দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে বৈষম্য আরও বাড়ছে। সব রকম বৈষম্য বাতিল করে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করা হলে ‘সবার জন্য শিক্ষা’ ‘অধিকার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। কিন্তু সেটা আমাদের দেশে কবে হবে, আদৌ হবে কি না কে জানে!
যাহোক, সামগ্রিক শিক্ষা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি তুলে লাভ নেই, কেননা এই সরকারের পক্ষ থেকে নানা বিষয়ে সংস্কার কমিটি করা হলেও শিক্ষা নিয়ে কোনো কমিটি করা হয়নি। তার মানে শিক্ষা তাদের অগ্রাধিকার তালিকায় নেই। এই মুহূর্তে পাঠ্যবই সংকট নিরসনে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। অন্তত আগামী বছর যেন এমন সংকট না হয়, সে জন্য সরকারকে আগাম পরিকল্পনা করে মুদ্রণ ও সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, টেন্ডার প্রক্রিয়ার সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে আরও দ্রুত মুদ্রণ কার্যক্রম শুরু করা উচিত। এ ছাড়া ভবিষ্যতে পাঠ্যবই বিতরণের সময়সীমা নির্ধারণ ও তা কার্যকর করার জন্য কঠোর তদারকি দরকার।
পরিশেষে, পাঠ্যবই সংকট নিরসন করে শিক্ষাব্যবস্থাকে স্বাভাবিক করতে সরকার, শিক্ষাবিদ, প্রকাশক এবং মুদ্রণ মালিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে নিরবচ্ছিন্ন ও সময়মতো বই সরবরাহ নিশ্চিত করা সরকারের এক নম্বর অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট