প্রযুক্তির সর্বসাম্প্রতিক উদ্ভাবন বিষয়ে বিশ্বের দু’জন শীর্ষ ধনকুবের ইলন মাস্ক এবং জ্যাক মার একটি মুখোমুখি কথোপকথনের চুম্বক অংশ প্রকাশ করা হয়েছে। দু’জনেই তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত। দু’জনের বক্তব্য দু’রকমেরই শুধু নয়; পরস্পরবিরোধীও বটে। ইলন মাস্কের শঙ্কা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের ফলে এক সময়ে পৃথিবী মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে কিংবা ধ্বংস হয়ে যাবে। পরিণতিটা দাঁড়াবে এই, মানুষকে বসবাসের জন্য বিকল্প স্থান খুঁজতে হবে। মঙ্গল গ্রহ হতে পারে তেমন একটি বিকল্প। জ্যাক মা অমনটা মনে করেন না। তাঁর মতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা স্মার্ট হবে ঠিকই, কিন্তু মানুষ তার নিজের ওই স্মার্ট সৃষ্টির চেয়েও অধিক স্মার্ট থাকবে, এখন যেমন রয়েছে। ফলে মানুষই যন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করবে; যন্ত্র মানুষকে সেবা করার কাজ চালিয়ে যাবে। জ্যাক মা কমিউনিস্ট বিশ্বে বড় হয়েছেন। সে জন্যই হয়তো মানুষের মানবিক ক্ষমতায় এখনও আস্থা হারাননি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ইলন মাস্কের সে আস্থাটা নেই। তবে তারা দু’জনেই বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উদ্ভাবনের সুফল যা পাওয়া যাবে তা নিজের দিকে টেনে নিতে কসুর করবেন না। ইলন মাস্ক তো ইতোমধ্যে মঙ্গল গ্রহে বসবাস স্থাপনের প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণাতেও অর্থ বিনিয়োগ করে যাচ্ছেন। গাছেরটা এবং তলারটা, কোনোটাকেই ইলন মাস্ক হাতছাড়া হতে দেবেন না।
জ্যাক মা যে প্রযুক্তির সাহায্যে মানুষের অবস্থার উন্নয়নে আস্থা রাখেন, তার অবশ্য একটা ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে। সেটা এই যে, প্রযুক্তি এ পর্যন্ত মানুষের সঙ্গে গায়ে পড়ে শত্রুতা করেনি; মানুষকে সাহায্যই করেছে। বাষ্পীয় শক্তি, বিদ্যুৎ, কম্পিউটার– এগুলো আগের তিনটি শিল্পবিপ্লব ঘটানোর পেছনে সক্ষমতা জুগিয়েছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ওই ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে– এমনটাই তাঁর আশা। তবে প্রযুক্তির উপকারী চরিত্রের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের সংশয় যে নেই, তা তো নয়। বিলক্ষণ রয়েছে। একটা কথা তো স্থূল সত্য, প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে যেভাবে গণহত্যার ঘটনা ঘটানো হয়েছে– তা মোটেই আশাবাচক নয়। এর দায় অবশ্য প্রযুক্তির নয়, মানুষেরই। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে প্রযুক্তির মালিকদের। প্রযুক্তি নৈতিকতার শিক্ষা দেয় না; নৈতিকতার ব্যাপারটা পুরোপুরি মানবিক। প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষ মানুষকে মারবে কি মানুষের সুখ বৃদ্ধি ঘটাবে– সেই সিদ্ধান্ত যন্ত্র নেয় না, যন্ত্রের মালিকরাই নিয়ে থাকেন।
জ্যাক মা বলেছেন, কম্পিউটারে শুধু চিপ থাকে; মানুষের থাকে হৃদয়। খুবই সত্য কথা। কিন্তু শঙ্কাটা এই যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হৃদয়ের ব্যবহার কমিয়ে দেবে। এখানে যে প্রশ্নটা একেবারে প্রাথমিক, এই প্রযুক্তির মালিকানা কার হাতে থাকবে? গোটা ব্যবস্থাই তো পুঁজিবাদী এবং এতে মালিক তিনিই হবেন, যার দখলে পুঁজি রয়েছে। মালিক হবেন ইলন মাস্ক ও জ্যাক মার মতো ব্যক্তিরাই, যারা হৃদয়ের নির্দেশ দ্বারা নয়, মুনাফালিপ্সা দ্বারাই পরিচালিত হবেন। বিশ্বের সর্বত্র আজ দেখা যাচ্ছে গণতন্ত্র পথ ছেড়ে দিচ্ছে কতিপয়তন্ত্রের জন্য। কতিপয়তন্ত্র ধনীদের সংঘ। আগামীতে তাদের এই অগ্রযাত্রা বাড়বে বৈ কমবে না।
পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং তাঁর এক বক্তৃতায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, মানুষের মস্তিষ্কের ভেতরে পদার্থবিজ্ঞান কাজ করে। এটা বৈজ্ঞানিকভাবেই সত্য। সত্য এটাও যে, পদার্থবিজ্ঞান মস্তিষ্ককে কৃত্রিম করে না, তাকে সজীব ও কার্যকর রাখে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও পদার্থবিজ্ঞানের অবদান হিসেবে আবির্ভূত। কিন্তু নতুন উদ্ভাবনাটির বেলাতে যেটা দেখা দেবে বলে আশঙ্কা তা হলো, পদার্থই প্রাণবান হয়ে উঠছে, মস্তিষ্ক এবং হৃদয়ের প্রাণকে দমিয়ে দিয়ে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আচরণটি রূপকথার সেই দৈত্যের মতো দাঁড়াতে পারে, যে বলত কাজ দে, নইলে ঘাড় মটকাব। এমনটা ঘটলে মালিকরা সতত কর্মপ্রার্থী যন্ত্রটির তুষ্টিসাধনে ব্যস্ত থাকবেন এবং তেমন সব কাজেরই জোগান দেবেন, যা মুনাফা আনবে। আর সেসব কাজ দাঁড়াবে চলমান তিন ধরনের গণহত্যার একটি কিংবা একসঙ্গে তিনটিরই সহযোগী।
বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র বসুর চাঞ্চল্যকর আবিষ্কারগুলোর একটি, জীবের মতো জড়েরও সাড়া দেবার সক্ষমতা রয়েছে। জগদীশচন্দ্র বসু দেখালেন, একটি টিন, গাছের একটি ডগা এবং ব্যাঙের একটি পেশি– এরা সবাই বাইরের উত্তেজনায় সাড়া দেয়। জগদীশচন্দ্র বসু এভাবে জীব-পদার্থবিজ্ঞানের পথিকৃৎদের একজন হয়ে রয়েছেন। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে তো প্রাণের চেয়ে বড় হয়ে উঠবে যন্ত্র এবং যন্ত্র নিজেই হয়তো আরও উন্নত যন্ত্রের উদ্ভাবন ঘটাবে। হতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ঘটে আরও অনেক আধুনিক ও স্মার্ট যন্ত্রের উদ্ভাবন জমা হয়ে রয়েছে।
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতে এলিয়েনদের রাজত্বের কথা শোনা গেছে। প্রযুক্তির গড়া নতুন পৃথিবীতে হয়তো এলিয়নদেরই রাজত্ব কায়েম হবে। তবে তারা ভিন্ন কোনো গ্রহ থেকে আসবে না। তৈরি হবে আমাদের এই গ্রহেই এবং তৈরি করবে অন্য কেউ নয়; মানুষ নিজেই; নিজের মাথা খাটিয়ে। যন্ত্রসভ্যতার সেই ভয়াবহ সময়ে এলিয়েনদের ভয়ে মানুষকে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে। কিন্তু পালাবে কোথায়? ইলন মাস্ক জানাচ্ছেন, পালাবে মঙ্গল গ্রহে। কিন্তু সেখানে যাবার খরচপাতি তো আছে, সেটা কে জোগাবে? নিশ্চয়ই মাস্ক সাহেব জোগাবেন না। খরচপাতি তারাই করতে পারবেন, যারা ধনী। বাকিরা কী করবেন? সে কথার উত্তর মাস্ক সাহেবরা দেবেন না। ওইসব ব্যাপারে তাদের মুখের মাস্ক অবিচলিতই থাকবে।
খুব স্থূল শঙ্কা এটাও, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বৈপ্লবিক শিল্পবিপ্লবের যুগে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক বেকারত্ব দেখা দেবে। দশজনের কাজ যদি তিনজনে করতে পারে তাহলে বাকি সাতজনকে কে যাবে নিয়োগ দিতে? ওই সাতজন তখন কী করবে? তারা তো কেবল বেকার নয়, প্রথমে অপ্রয়োজনীয় পরে বোঝা হয়ে দেখা দেবে।
নানা বিবেচনাতেই তাই সতর্কতা প্রয়োজন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য যারা প্রতিযোগিতামূলক বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করছেন, তাদের জানানো দরকার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবশ্যকতা আমরা মানি, প্রয়োগও চাই, কিন্তু তার শাসন চাই না। সে জন্য ওই ক্ষেত্রে বিনিয়োগটা কমিয়ে বরং মানুষের প্রাথমিক প্রয়োজনগুলো মেটানোর ব্যাপারে টাকা খরচ করুন।
বলাই বাহুল্য, এসব নীতিকথা পুঁজির মালিকরা শুনবেন না। যারা হৃদয়বান ও বুদ্ধিমান সেই মানুষদের কর্তব্য প্রতিবাদী আওয়াজ তোলা এবং আওয়াজটাকে জোরদার করা। তবে কাজটা বিচ্ছিন্নভাবে করলে কুলাবে না। করতে হবে সংঘবদ্ধভাবে। তার জন্য সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি দরকার হবে। যে প্রস্তুতির লক্ষ্য থাকবে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানাকে হটিয়ে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা। ওই লক্ষ্য অর্জনে চাই সামাজিক বিপ্লব; প্রতিটি দেশে এবং সারাবিশ্বে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের তুলনায় এখন যা অধিক ও আশু প্রয়োজন তা হলো, সামাজিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিমালিকানাকে হটিয়ে সমষ্টিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ পুঁজিবাদকে বিদায় করে সমাজতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হওয়া।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়