দেশি-বিদেশি চাপ, নিন্দা কিংবা সমালোচনা যতই থাকুক না কেন, কোনো পরিস্থিতিতেই জামায়াত সঙ্গ ছাড়ছে না বিএনপি। তেমনি বিএনপিকেও ছাড়ছে না জামায়াতে ইসলামী। যে কোনো পরিস্থিতিই গাঁটছড়া অটুট রাখবে দল দুটি। অবশ্য বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কৌশল পাল্টেছে তারা। সরকারের চাপ ও সুশীল সমাজের সমালোচনা এড়াতে এবং বিদেশিদের চোখে ধুলো দিতে রাজনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাখঢাক করে চলবে বিএনপি ও জামায়াত। এ কারণে সাময়িকভাবে ২০ দলে নিষ্ক্রিয় থাকবে জামায়াত। দলীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন আভাসই মিলেছে।
বিএনপি-জামায়াত জোট নিয়ে দেশে-বিদেশে নেতিবাচক ইমেজ তৈরি হলেও তাতে গা করছেন না বিএনপি নেতৃত্ব। বরং এ জন্য সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্রদের দায়ী করে আসছেন দলটির নেতারা। বিএনপি বরাবরই অভিযোগ করছে, আওয়ামী লীগ বিএনপির বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করছে। তারা বিএনপিকে নির্মূল করার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে বিএনপি ও জামায়াতকে নিয়ে নানা অপপ্রচার করছে। এমনকি তারা প্রতিনিয়ত রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে বিএনপির বিরুদ্ধে বক্তব্য অব্যাহত রেখেছে।
বিএনপি নেতারা বিশ্বাস করেন, বিএনপিকে দুর্বল করতেই সরকারি দল ও তাদের ‘মেশিনারিজ’ বিএনপি ও জামায়াতকে নিয়ে নানা রকম গল্প প্রচার করছে যাতে পরিস্থিতির বাস্তবতায় বিএনপি-জামায়াত ঐক্যে ফাটল ধরানো যায়। ভোটের রাজনীতিতে জামায়াত যেহেতু একটি বড় ফ্যাক্টর; সেহেতু বিএনপি জোট থেকে জামায়াতকে বের করতে পারলে বিএনপির ভোট ব্যাংক দুর্বল করা যাবে। পাশাপাশি জামায়াতকে সরকারি দলের বগলদাবা করা সহজ হবে। আওয়ামী লীগ যদি জামায়াতকে কাছে টানতে না-ও পারে ২০ দল থেকে জামায়াতকে আলাদা করতে পারাও আওয়ামী লীগের বড় সাফল্য বলে ধরা হবে। এ কারণেই আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় সব যন্ত্রকে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে লাগিয়েছে। তারপরও বিএনপি নেতারা বিশ্বাস করেন, কোনো পরিস্থিতেই বিএনপি থেকে আলাদা হচ্ছে না জামায়াত।
তবে ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় দলের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি ও দণ্ড কার্যকর হওয়া এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় অনেকটাই বেকায়দায় রয়েছে জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্ব। প্রকাশ্যে দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে না পারায় বিএনপির কাঁধে ভর করা ছাড়া উপায়ও নেই দলটির। কিন্তু পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে বিএনপি ও জামায়াত কিছু কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা বিএনপি-জামায়াতের দূরত্ব হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এর সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের হরিহর আত্মায় ভাঙনের সঙ্গে কোনো যোগসূত্র নেই। বিষয়টি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কথায়ও স্পষ্ট। তিনি বলেন, আদর্শগতভাবে জামায়াত বিএনপিকে ছাড়বে কিংবা বিএনপি জামায়াতকে ছাড়বে এটা আমার মনে হয় না। তাদের চিন্তা-ভাবনা, আদর্শ ও চেতনা খুব কাছাকাছি নয়? অনেক কাছাকাছি। যদি বিএনপি-জামায়াত সম্পর্ক ছিন্ন করার মতো বিষয় আসে, তাহলে তা হবে কৌশলগত।
প্রেমিক-প্রেমিকার প্রেমের গভীরতার পর্যায়ের মতো বিএনপি-জামায়াত কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে, এই মন্তব্য করে তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেন, বিএনপি যদি জামায়াতকে ত্যাগ করত,বলত আমরা বিশ বছর ধরে যুদ্ধাপরাধী দলের সঙ্গে যে সংসার করেছি এতে আমরা ভুল করেছি। আমাদের এখন উপলব্ধি হয়েছে যুদ্ধাপরাধীর দলের সঙ্গে আমরা আর থাকব না এই ঘোষণা দিয়ে যদি বিএনপি জামায়াতকে তাদের জোট থেকে বের করে দেয় তাহলে অবশ্যই বিএনপিকে আমরা সাধুবাদ জানাব।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়কারী নজরুল ইসলাম খান গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বলেন, জামায়াত বিএনপিকে ছেড়ে যাচ্ছে, এমন কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। আমরা জানিও না। বিএনপি জামায়াত ছেড়ে দেবে কিংবা জামায়াত বিএনপিকে ছেড়ে দেবে এমন নতুন কোনো আলোচনা হয়নি। তিনি জানান এমন কিছু হলে আপনারা জানবেন। আপনাদের জানাব।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী গতকাল জানান, এ বিষয়ে দলের কোনো ফোরামেই আলোচনা হয়নি। এটা নীতিনির্ধারণী ফোরামের ব্যাপার এ নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা হতে হবে, মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত হতে হবে। তারপর দল সিদ্ধান্ত নেবে। দলের মধ্যেও তো এটা নিয়ে মতবিনিময়ের ব্যাপার আছে। তিনি বলেন, জামায়াতের সিদ্ধান্তের কথা বলতে পারব না। আমরা আমাদের সিদ্ধান্তের কথা বলতে পারব। তিনি বলেন, আমার জানা মতে, এ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের কোনো আলোচনা হয়নি।
আমির খসরু বলেন, জামায়াত যদি বিএনপি থেকে দূরে থাকতে চায়, সেটা যার যার নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, রাজনীতিতে কোয়ালিশন হবে, পার্টি আসবে, পার্টি যাবে। এগুলো নর্মাল ব্যাপার। তিনি বলেন, এখানে মেইন স্টিম পার্টি হচ্ছে বিএনপি। বিএনপি কী ভাবছে সেটাই হলো মূল বিষয়।
বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমেদ বলেন, জাতীয়ভাবে অনেকে চাচ্ছে না, আন্তর্জাতিক বিশে^ বিএনপি-জামায়াত জোট নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, জামায়াতও বিএনপির সঙ্গে কাজ করে খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। সুতরাং বিএনপি জামায়াতের আলাদা আলাদা কাজ করা উচিত বলে আমি মনে করি। তিনি বলেন, জামায়াত বিএনপিকে ছেড়ে দেবে এটা কী করে হয়। জামায়াত এখন নিবন্ধিত দল নয়। জামায়াতের বিএনপিকে ছেড়ে দেয়া হাস্যকর ব্যাপার। তিনি বলেন, এটা সমঝোতার ভিত্তিতে হওয়াটাই ভালো। বিএনপি নিজের মতো থাকুক আর জামায়াত নিজের মতো কাজ করুক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে পারে; কিন্তু রাজনৈতিক বা নির্বাচনের সময়ে তাদের পৃথক থাকা দরকার। তিনি বলেন, জামায়াত ছাড়া ২০ দলীয় জোট ১৯ দলীয় জোট হলে তাতে ক্ষতি কি? আফসোস করে এই শিক্ষাবিদ বলেন, আমাকে যখন বলা হয় বিএনপি-জামায়াতের বুদ্ধিজীবী, এটা সহ্য করতে পারি না। সারাজীবন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে আসছি, মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রাণ দেয়ার জন্য প্রস্তুত থেকে এখন জামায়াতের সঙ্গে ব্র্যাকেট করে কথা বলা হবে সেটা তো হয় না।
রাজনীতি