দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৩৩টি খাতে দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে । এসব প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি বন্ধ করতে দুদকের পক্ষ থেকে ২১ দফা সুপারিশ করা হয়েছে।
শেরেবাংলা নগরে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) সোমবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশ হস্তান্তর করেছেন দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান।
রিপোর্ট জমা দেয়ার সময় মোজাম্মেল হক প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের উদ্ধৃতি টেনে বলেন, দেশের উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে দুর্নীতি দমনের যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন তা আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে পেয়েছি।
দুদক কমিশনার বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিক টিমসমূহের কার্যক্রম সমন্বিত উদ্যোগরই একটি অংশ।
অর্থমন্ত্রী দুদকের এই কার্যক্রমকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি কমকর্তা-কর্মচারীকে দুর্নীতিমুক্ত থাকতে হবে।
দুর্নীতির সম্ভাব্য ৩৩ খাত :
অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দুর্নীতির যে ৩৩টি সম্ভাব্য খাত উঠে এসেছে সেগুলো হলো, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর নতুন কর্মস্থলে বেতন প্রেরণে বিলম্ব, অবসরে গমনকালে সর্বশেষ বেতনপত্র (ইএলপিসি) ইস্যুর ক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্ব, সার্ভিস স্টেটমেন্ট ইস্যুর ক্ষেত্রে হয়রানিযুক্ত সেবা, সার্ভিস বুক ভেরিফিকেশনের অনিয়মিতভাবে অর্থ আদায়, সিলেকশন গ্রেড/টাইম স্কেলে অনিয়মিতভাবে আর্থিক সুবিধা, পে-ফিক্সেশনের বেলায় অনিয়মিতভাবে আর্থিক সুবিধা প্রদান, ভবিষ্যৎ (জিপিএফ) হিসাব খোলার সময় অনিয়মিতভাবে অর্থ আদায়, জিপিএফ অগ্রিমের অর্থ উত্তোলনের ক্ষেত্রে অনিয়মিতভাবে আর্থিক সুবিধা , জিপিএফ হিসাব হতে আর্থিক সুবিধার দাবি।
অন্য উৎসগুলো হলো, সরকারি বিভিন্ন বিলের অর্থ প্রাপ্তিতে অনিয়মিত আর্থিক সুবিধা, প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকসহ কর্মচারীদের পেনশন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অনিয়মিত অর্থ প্রদান করা, ভ্রমণভাতার বিল পরিশোধে অনিয়মিত অর্থ পরিশোধ, বিভিন্ন খাতের বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট হারে অর্থ প্রদান, শ্রান্তি-বিনোদন ভাতার বিল উত্তোলনের বেলায় অনিয়মিত অর্থ পরিশোধ, বিল দাখিলের ক্ষেত্রে টোকেন প্রদানের সময় হয়রানির, নব নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রথম বেতন বিলের টাকা প্রাপ্তিতে অনিয়মিত অর্থ প্রদান, ভুয়া পেনশনসংক্রান্ত বিল পরিশোধের মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করা।
উৎসের মধ্যে আরও রয়েছে ভুয়া ভ্রমণভাতা বিল পরিশোধের মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করা, উন্নয়ন প্রকল্প হতে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত বেতন-ভাতা পরিশোধের সময় অনিয়মিতভাবে অর্থ আদায়, সরকারি দপ্তরসমূহ অনিয়মসমূহের ওপর যথাযথ প্রি-অডিট আপত্তি, সরকারি দপ্তর কর্তৃক ভ্যাট-আইটি-কাস্টমস ডিউটি কর্তন না করে রাজস্ব আদায়ের প্রতিবন্ধকতা।
উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে অর্থ ছাড় ফান্ড রিলেজের বেলায় প্রতিবন্ধকতা, হয়রানি, জুন মাসে যথাযথ প্রি-অডিট না করে অনিয়মিত আর্থিক সুবিধা নিয়ে বিল পাস করা ,সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে মাস ভিত্তিতে সমরূপে ব্যয় না করে অর্থ বছরের শেষ প্রান্তে তথা এপ্রিল, মে, জুন মাসে অর্থ ছাড় করা ও প্রি-অডিট না করে বিলসমূহ পাস করা।
হিসাব রক্ষণ অফিস কর্তৃক বিভিন্ন অফিসের পে-রোলে নাই এমন ব্যক্তিদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করে সরকারি অর্থের আত্মসাৎ, ব্যাংক কর্তৃক পরিশোধিত মাসিক পেনশনের টাকা হিসাব অফিস কর্তৃক পুনর্ভরণের ক্ষেত্রে কখনো কখনো ভুয়া বিল বা ডুপ্লিকেট বিলের মাধ্যমে সরকারি অর্থের ক্ষতি ও আত্মসাৎ।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত বিলের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট অডিট আপত্তি উত্থাপন না করা, নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে বেতন-ভাতা পরিশোধের নির্দেশনা অমান্য করে সরকারি সেবা গ্রহীতাদের হয়রানি করা হয় আইবিএএস বরাদ্দ জটিলতা দেখিয়ে হয়রানি, বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও বরাদ্দ নেই বলে বিলম্ব করা ও ভোগান্তি সৃষ্ট, দাখিলকৃত কাগজপত্র সঠিক ও পর্যাপ্ত নয় মর্মে অতিরিক্ত অর্থ দাবি, ব্যাংকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে এডভাইস প্রদান না করা, সঠিক বরাদ্দ পাওয়ার পরেও অর্থনৈতিক কোড নিয়ে বিড়াম্বনা ও ভোগান্তি সৃষ্ট করা।
দুর্নীতি নিরসনে দুদকের ২১ সুপারিশ :
সিজিএ কার্যালয় কর্তৃক মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তা কর্মচারীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষায় ভিডিও কনফারেন্স প্রযুক্তির ব্যবহার, হিসাব রক্ষণ অফিসসমূহে যে জনবল বাড়ানো, একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ আইটি সেট আপ করা, আইটি সাপোর্ট দেওয়ার জন্য প্রতিটি হিসাব রক্ষণ অফিসে একজন দক্ষ লোক নিয়োগ, ই-প্লানিং কার্যক্রম গ্রহণ,
সবধরনের বিল নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা, পেপারলিস সাইবার এসিভ ব্যবস্থা করা, হিসাব রক্ষণ অফিসের জন্য অভিযোগ বক্স করা, অভিযোগ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি সহজীকরণ, ভুক্তভোগীদের অভিযোগ দাখিল, শুনানি ও নিষ্পত্তির ব্যবস্থা, আইবি এ এস কম্পিউটার সরবরাহ নিশ্চিত করা।
প্রতিরোধে অন্য প্রদক্ষেপ হলো, দাপ্তরিক কাজে গতিশীলতা ও স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যে তিন বছর অন্তর বদলি, পেনশনসংক্রান্ত কার্যক্রমকে স্বচ্ছ, দ্রুত করা, উপজেলা- জেলা ও বিভাগীয় মাঠ পর্যায়ের অফিসগুলোতে নিয়মিত পরিদর্শনে, বেতন-ভাতাসহ সব ধরনের বিল পরিশোধের বেলায় দায়িত্ব অবহেলা ও বিলম্বের জন্য দায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দায়-দায়িত্ব নিরূপণ করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা; প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয় ও বিভাগীয় ‘হট লাইন’ স্থাপন।
‘হট লাইনের’ মাধ্যমে প্রাপ্ত অভিযোগগুলো নিয়মিত পর্যালোচনা করা, হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা, অডিটর পর্যায়ে তথা সিদ্ধান্ত প্রদানকারী পর্যায়ে স্থানীয় কর্মকর্তা/কর্মচারী নিয়োগ না দেওয়া সরকারি নিয়ম অনুযায়ী নিয়মিত বদলি, কাজের গতিশীলতা ও স্বচ্ছতার লক্ষ্যে বরাদ্দ হিসাব রক্ষণ অফিসে পাঠানো, আই বি এ এস সম্পর্কে হিসাব রক্ষণ কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের অদক্ষতা ও অস্পষ্টতা লক্ষ্য করা।