কাটছে না বুড়িগঙ্গা প্রথম সেতুর টোল জটিলতা । গত বছরের অক্টোবরে টোল মওকুফের দাবিতে আন্দোলনের পর টোল আদায় বন্ধ থাকলেও ওই সেতুর টোল ফ্রি করেনি সরকার। অন্যদিকে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের ভয়ে নতুন করে টোল আদায় করছে না সড়ক ও জনপথ বিভাগ। তবে পুলিশ ও স্থানীয় প্রভাবশালী চক্র নামে-বেনামে পরিবহন থেকে প্রতিদিনই বিপুল অঙ্কের চাঁদা আদায় করছে।
বুড়িগঙ্গা প্রথম সেতুর টোল ফ্রি’র বিষয়ে ফাইল চালাচালি হলেও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে টোল বহাল রাখার সিদ্ধান্ত দেয়ায় তা আলোর মুখ দেখছে না। সরকারের সংশ্লিষ্টদের অভিমত, সরকারের রাজস্বের জন্য টোল বহাল রাখতে হলে, ওই সেতুতে পরিবহনে পুলিশ ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাঁদাবাজি বন্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন। তাহলে পরিবহন চালক ও মালিকদের ক্ষোভ নিরসন হবে এবং তারা টোল দিতে আগ্রহী হবেন। নইলে পরিবহন মালিক ও চালকরা ক্ষুব্ধ হবেন এবং পরবর্তী সময়ে এ ইস্যুতে আন্দোলনও হতে পারে।
এ ছাড়াও সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের পক্ষ থেকে বুড়িগঙ্গা প্রথম সেতুর টোল ফ্রি করতে ঢাকা থেকে প্রবেশ ও বের হওয়ার পথের জন্য ব্যবহৃত বুড়িগঙ্গার দ্বিতীয় সেতু, বুড়িগঙ্গা তৃতীয় সেতু, কাঁচপুর সেতু, সুলতানা কামাল সেতু ও শীতলক্ষ্যা সেতুকে টোল ফ্রি রাখার যুক্তিও দেখানো হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রস্তাবে। তবে এসব কিছুর পরও রাজস্বের প্রয়োজনে সরকার প্রথম বুড়িগঙ্গা সেতুর টোল আদায় বহাল রাখার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, বুড়িগঙ্গা প্রথম সেতুর টোল মওকুফের জন্য সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হলে তা নাকচ করে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এখন পরবর্তী সিদ্ধান্তের জন্য সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিদ্ধান্তের জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে, সেখান থেকে যে সিদ্ধান্ত আসবে, আমরা সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করব।
তিনি বলেন, সরকার যদি নতুন করে বুড়িগঙ্গা প্রথম সেতুর টোল ফ্রি করে, আমরা ওই সেতুকে টোল ফ্রি ঘোষণা করব। আর যদি টোল ফ্রি না করে তবে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করব। এক্ষেত্রে একটি বিষয় মাথায় রেখে কাজ করতে হবে- পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা ওই সেতুটি টোল ফ্রি করতে চান, এজন্য সেখানকার অন্যান্য পরিবেশ উন্নয়নেও কাজ করতে হবে। গত বছরের আন্দোলনে একজন শ্রমিক মারা গেছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু বা বুড়িগঙ্গা প্রথম সেতুর টোল আদায় শুরু হয় ১৯৮৯ সালে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ইজারাদার প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে টোল আদায় করেছে সরকার। ২০১৫ সালের ২৪ জুলাই থেকে বিভাগীয়ভাবে টোল আদায় শুরু হয়। এ অবস্থায় টোল নীতিমালা-২০১৪ বাস্তবায়নের নির্দেশনা জারি করে সরকার। পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় বিভাগীয়ভাবে টোলের নতুন হার বাস্তবায়নের চেষ্টা করে বাস-ট্রাক মালিক সমিতি। তবে বিভিন্ন মহলের বাধায় এ উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।
তারপর ২০১৭ সালের ১৫ মে টোল নীতিমালা-২০১৪ বাস্তবায়নের জন্য নতুন ইজারাদার নিয়োগের দরপত্র আহ্বান করে সড়ক ও জনপদ অধিদফতর। এ সময় ‘কে আলম শিপিং লাইন’ নামের ইজারাদার প্রতিষ্ঠানকে একুশ কোটি ২৯ লাখ ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে ৩ বছরের জন্য ইজারা দেয়া হয়। ওই বছরের ২১ অক্টোবর টোল আদায়ের দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী প্রথম কিস্তি বাবদ সর্বসাকুল্যে ৪ কোটি ৭৭ লাখ ৮৪ হাজার ১৮৪ টাকা এবং নিরাপত্তা জামানত হিসেবে ২ কোটি ৯৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা জমা দেয় ইজারাদার প্রতিষ্ঠান।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ থেকে ২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট ২৭৪ নম্বর স্মারকে এ সেতুর টোল মওকুফের বিষয়ে অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর চিঠি দেয়। এ ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্মতি দিলেও বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য সারসংক্ষেপ পাঠালে টোল মওকুফের প্রস্তাব নামঞ্জুর করেন তিনি।
২১ জানুয়ারি এ বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ থেকে বিষয়টি পুনরায় বিবেচনার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়। এর জবাবে ২৪ ফেব্রুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে চিঠি দিয়ে বুড়িগঙ্গা প্রথম সেতুর টোল মওকুফের বিষয়ে ২০১৬ সালের ১৮ ডিসেম্বরের সম্মতি প্রত্যাহার করা হয়।
এদিকে ইজারাদার ৪ মার্চ সড়ক ও জনপথ বিভাগের মুন্সীগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুনুর রশীদ তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বরাবর লেখা এক পত্রে বলেছেন, গত বছরের ২৬ অক্টোবর বুড়িগঙ্গা প্রথম সেতুতে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের আন্দোলনের ঘটনা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। এ ঘটনায় সড়ক ও জনপথ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর মৌখিক নির্দেশে টোল আদায় বন্ধ রাখা হয়। এরপর সেতুর ইজারাদার ‘কে আলম শিপিং লাইন’ গত বছরের ২৭ অক্টোবর ও ৫ নভেম্বর টোল আদায় শুরুর অনুমতি চেয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী বরাবর দু’দফা আবেদন করেছে।
পরবর্তী সময়ে ইজারাদার প্রতিষ্ঠান গত বছরের ২ ডিসেম্বর আদালতে রিট পিটিশন করে। ওই রিট পিটিশনে আদালত ইজারাদারকে টোল আদায়ের অনুমোদনের নির্দেশ দেন। এরপরও সেটা বাস্তবায়ন করা হয়নি, পরবর্তী সময়ে ১৩ জানুয়ারি ইজারাদারের আইনজীবী মারফত লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়ে জানিয়েছে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে টোল আদায়ের অনুমোদন না দিলে কনটেম্পট (ঈড়হঃবসঢ়ঃ) পিটিশন দায়ের করবেন তারা। সার্বিক দিক বিবেচনায় এই প্রকৌশলী ইজারাদারের অনুকূলে টোল আদায়ের অনুমোদন দেয়ার প্রস্তাব করেছে। এ প্রস্তাব সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, প্রধান প্রকৌশলী হয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিবের কাছে পাঠানো হয়েছে।
সূত্র মতে, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দিধাদ্বন্দ্বে পড়ায় পুনরায় ওই সেতুর টোল ফ্রি করার উদ্যোগ নিতে পারে। আর সেটা না করলে টোল আদায়ের অনুমোদনও দিতে পারে। তবে সরকারের বুড়িগঙ্গা প্রথম সেতুর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশাসনিক ও আইনগত বাধ্যবাধকতার কারণে বুড়িগঙ্গা প্রথম সেতুর ইজারাদারকে টোল আদায়ের অনুমোদন না দিলে একদিকে আইনি জটিলতায় পড়তে হবে, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী নাখোশ হবেন; সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হবে। এসব দিক বিবেচনায় এখন পুলিশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করে ওই এলাকার পরিবহনের চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। তাহলে সার্বিক পরিস্থিতি ঠিক রেখে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
এ প্রসঙ্গে ইজারাদার প্রতিষ্ঠান ‘কে আলম শিপিং লাইনের’ কর্মকর্তা মো. আলম গণমাধ্যমকে বলেন, সরকারের যথাযথ নিয়ম মেনে আমরা বুড়িগঙ্গা প্রথম সেতুর টোল ইজারা নিয়েছি। এজন্য সরকারি কোষাগারে জামানত ও অগ্রিম হিসেবে বেশকিছু টাকাও জমা দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ সেতুর টোল আদায় বহাল রাখার সিদ্ধান্ত এলেও রহস্যজনক কারণে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ আমাদের টোল আদায় থেকে বিরত রেখেছে।