প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বলেছেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পূর্ণ নিরাপত্তা পদ্ধতি অবলম্বন করে এমনভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে যাতে এখানে প্রাকৃতিক বা মনুষ্য সৃষ্ট কোন দুর্ঘটনা ঘটতে না পারে।
জনগণের জন্যে কোন ঝুঁকি যাতে সৃষ্টি না হয়, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অলম্বন করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাশিয়া এই প্লান্টের বর্জ্য নিতে রাজী হয়েছে এবং এ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা নিরাপত্তার দিকটায় বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছি। যে কোন দুর্যোগে আমাদের এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে দিকটি বিবেচনায় নিয়েই এই প্ল্যান্টের ডিজাইন করা হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ এখানে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ‘রিঅ্যাক্টর বিল্ডিং (উৎপাদন কেন্দ্র)’ নির্মাণ কাজের দ্বিতীয় পর্যায়ের ঢালাইয়ের কাজ উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটি নির্মাণে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার গাইডলাইন এবং আন্তর্জাতিক মান অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হচ্ছে। রাশিয়ার সর্বশেষ জেনারেশন থ্রি প্লাস প্রযুক্তির রিঅ্যাক্টর দিয়ে তৈরি হচ্ছে এই কেন্দ্র। পারমাণবিক নিরাপত্তা ও বিকিরণ নিয়ন্ত্রণের সর্বাধুনিক ব্যবস্থা আছে এ রিঅ্যাক্টরে।’
তিনি আশা প্রকাশ করেন, বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের যাত্রায় এই পারমাণবিক কিদ্যুৎ কেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় বিদ্যুৎকে একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম চাবিকাঠি উল্লেখ করে বলেন, পর্যাপ্ত এবং ধারাবাহিক বিদ্যুৎ সরবরাহ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করারও পূর্বশর্ত।
সরকার দেশের প্রত্যেকটি মানুষের ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানোর মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।
তিনি আশা প্রকাশ করেন- ২০২৩-২৪ সাল নাগাদ এ কেন্দ্রের দু’টি ইউনিট থেকে মোট ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে ।
রাশিয়ান ফেডারেশনের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইউরি ইভানোভিচ বরিসভ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেজ ওসমান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন।
রোসাটম-এর প্রথম মহাপরিচালক ল্যাক্সিন আলেকজান্দার, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি কমিশন (আইএই)-র পরিচালক দহি হ্যান অনুষ্ঠনে বক্তৃতা করেন।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আনোয়ার হোসেন একটি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে পুরো প্রকল্পটি তুলে ধরে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন।
মন্ত্রী পরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সদস্যবৃন্দ এবং এনার্জী রেগুলেটরী কতৃর্পক্ষের সদস্যবৃন্দ, ভারত থেকে আগত জ্যেষ্ঠ পরমাণু বিষয়ক কর্মকর্তাবৃন্দ, তিন বাহিনী প্রধানগণ এবং পদস্থ সামরিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী এ প্রকল্পে সহযোগিতার জন্য এ সময় রুশ সরকার ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
তিনি বলেন, ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর প্রথম ইউনিটের প্রথম কংক্রিট ঢালাইয়ের পর বিগত সাত মাসে প্রথম ইউনিটের নির্মাণ কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। আজকে কংক্রিট ঢালাইয়ের মাধ্যমে শুরু হলো দ্বিতীয় ইউনিটের নির্মাণ কাজ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আমরা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে সমর্থ হব এবং বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর ৩৩তম সদস্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।
তিনি বলেন, এ ভূখন্ডে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের স্বপ্ন শুরু হয়েছিল ১৯৬১ সালে তৎকালীন পূর্ব বাংলায়। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণে তা আর আলোর মুখ দেখেনি। পরে পশ্চিম পাকিস্তানে সেটি সরিয়ে নেয়া হলে
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর অনেক কর্মসূচির মত এই প্রকল্পের কাজও বন্ধ হয়ে যায়।
সরকার প্রধান বলেন, ১৯৯৬ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পর আমরা জ্বালানি নীতিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করি এবং আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা ‘আইএইএ’-এর সহযোগতিা চাই। তাদের সহায়তায় আমরা একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনাও গ্রহণ করি। বিভিন্ন জটিল আইন-কানুন তৈরি করতে আমাদের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপর ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসেই আমাদের নেয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি বাতিল করে দেয়। এর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটিও ছিল।
রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প ছিল জাতির পিতার স্বপ্নের প্রকল্প উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৯ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে আমরা আবার প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করি। বন্ধুরাষ্ট্র রাশিয়া এটি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনেও রাশিয়া এবং সে দেশের জনগণ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমি কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁদের অবদানের কথা স্মরণ করছি।
প্রধানমন্ত্রী দেশে এক সময় দেশে ভয়াবহ লোড শেডিং থাকার কথা স্মরণ করে বলেন, ২০০৯ সালে সরকার গঠনের সময় আমরা বিদ্যুৎ পেয়েছিলাম মাত্র ৩২০০ মেগাওয়াট। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় তখন ভয়াবহ লোড-শেডিং হতো।
তিনি বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই আমরা বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানোর জন্য স্বল্প, মধ্যম এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করি। তার ফলেই আজ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ১৮ হাজার ৩৫৩ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। সুবিধার আওতায় এসেছেন ৯০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ।
টেকসই বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য তাঁর সরকার জ্বালানি নীতিতে জীবাষ্ম জ্বালানির পাশাপাশি বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারের উপর জোর দিয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তেল, গ্যাস বা কয়লার পাশাপাশি পারমাণবিক, সৌর এবং বায়ু-চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপর গুরুত্বারোপ করেছি।
দেশের আর্থ-সমাজিক উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী এ সময় মহাকাশে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট সফলভাবে উৎক্ষেপণের প্রসঙ্গও উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির জন্য তাঁর সরকার কর্মসূচি গ্রহণ করেছে বলেও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে এবং তাদের ভারত ও রাশান ফেডারেশনে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শুরু হয়েছে। শুধু পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নয়, স্যাটেলাইট পরিচালনার জন্যও আমরা নিজস্ব জনবল তৈরি করছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হবে। আমরা এই দুই শুভক্ষণকে সামনে রেখে দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতিকে আরও বেগবান করতে চাই।’
শেখ হাসিনা এসময় তাঁর রাজনৈতিক অঙ্গীকারের পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, আমাদের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, প্রযুক্তি নির্ভর জ্ঞানভিত্তিক মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করা।