‘এটি ঠিক বন্ধু সুলভ আচরণ নয়। ক্রাইস্ট চার্চের ঘটনার পর তারা এই সতর্কতা আবার জারি করল। এতে বাংলাদেশ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইশফাক এলাহী
নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অতীতের তুলনায় অনেক নিবিড়। দেশটি বাংলাদেশের অপরিহার্য ব্যবসায়ীক পার্টনার। এই দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রেই সর্বাধিক পরিমাণ পণ্য(গার্মেন্টসহ) রপ্তানি হয়ে থাকে। যা থেকে আমাদের প্রচুর বৈদেশিক মুনাফা অর্জিত হয়। এখন বাংলাদেশের কয়েক লাখ মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর অন্যতম একটি অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তি। সুতরাং রাজনৈতিকভাবে দেশটি কী ভাবল, কী প্রতিক্রিয়া দেখালো তা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বৈকি। এটা অস্বীকার করলে বোকামি হবে।
যুক্তরাষ্ট্রকে আমাদের বন্ধু বলেই আমরা মনে করি। ১৯৭১ সালের অবস্থান থেকে দেশটি অনেক সরে এসেছে। কিন্তু মাঝে মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আচরণে আমাদের হতাশ হতে হয়। মনে প্রশ্ন জাগে, নিক্সনের পলিসি এখনো কি বিদ্যমান? ১৫ মার্চ ক্রাইস্টচার্চে দুটি মসজিদে হামলার ঘটনার পর গত ৪ এপ্রিল ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস তাদের ওয়েবসাইটে মার্কিন নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই অশনি সংকেত দেওয়া নিয়ে কোনো রকমের ব্যখ্যা দেয়নি। ঢাকা কেন ঝুঁকিপূর্ণ?
সত্যিই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যটা বোঝা মুশকিল। যেখানে তারা ট্রাভেল অ্যাডভাইজরিতে পাকিস্তানের ব্যাপারে সতর্কতা ইস্যু করেনি, সেখানে বাংলাদেশের ব্যাপারে করাটা কি কোনো যুক্তিতে মেনে নেওয়া যায়? বাংলাদেশ কি পাকিস্তানের চেয়েও ঝুঁকিপূর্ণ? প্রশ্ন থাকে কিন্তু।
গত ৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের এই সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে খুবই সত্য কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি দেখেছি তারা এই সতর্কতা ইস্যু করেছে। কেন তারা এটা করেছে সে সম্পর্কে আমাদের কিছু জানায়নি এবং কোনো ব্যখ্যা দেয়নি। যদি তাদের কাছে এমন কোনো তথ্য থাকে যে সামনের দিনগুলোতে কোনো ঘটনা ঘটতে পারে, তাহলে আমাদেরকে জানানোও তাদের দায়িত্ব। তারা আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে জানাতে পারতো, যাতে আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারি।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরো বলেছেন, ‘সন্ত্রাস শুধু বাংলাদেশের জন্য না, এটি গোটা পৃথিবীর জন্যই একটি সমস্যা। একটি ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর আমাদের গোয়েন্দারা সার্বক্ষণিক সজাগ রয়েছে। আমরা বাংলাদেশ থেকে সন্ত্রাসবাদ সফলভাবে নির্মূল করেছি।’
বাংলাদেশের জনগণও মনে করে, আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের উপর সতর্কতার সিল এটে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস, জঙ্গী তৎপরতা একেবারে শুন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। কিছুদিন আগে ভারতের বিএসএফ দিল্লীতে একটি অনুষ্ঠানে উল্লেখ করেছে যে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার জঙ্গীবাদকে শুন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। বিএসএফ বাংলাদেশকে ধন্যবাদ বলেছে। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের কেন এই সতর্কতা? তারা তাদের নাগরিকদের দিতেই পারে সতর্কতা। কিন্তু একটি দেশে অবস্থানে সর্বোচ্চ সতর্কতা দেওয়ার পর সেই দেশটিকেও নিঃসেন্দহে অবহিত করা উচিত। আর এই অবহিত না করাটা অনেকটাই অসহোযোগিতা করার সামিল। তাদের ওয়েবসাইটে যে সতর্কতার কথা বলা হয়েছে সেটাকে কূটনৈতিক ভাষায় ট্রাভেল অ্যাডভাইজরি বলা হয়!
এ নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইশফাক এলাহীর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, ‘এটি ঠিক বন্ধু সুলভ আচরণ নয়। ক্রাইস্ট চার্চের ঘটনার পর তারা এই সতর্কতা আবার জারি করল। এতে বাংলাদেশ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। পশ্চিমা ব্যবসায়ি এবং পর্যটকরা তাদের কূটনৈতিক মিশনের পরামর্শ মনোযোগ সহকারে অনুসরণ করে থাকেন। এ ধরনের বার্তা তাদেরকে দেওয়ার ফলে অনেক ব্যবসায়ী বাংলাদেশ ভ্রমণ থেকে বিরত থাকতে পারেন। হয়তো এখানকার ব্যবসায়িক পার্টনারকে তারা বলবেন, তুমি ভারতে আসো বা সিঙ্গাপুরে আসো। এতে সময় ও অর্থ লোকসানের পাশাপাশি আমাদের ব্যবসায়িক কর্মকা- বিঘ্নিত হবে।’
‘এই ‘সতর্কতা’ ইস্যুর পেছনে তাদের (যুক্তরাষ্ট্রের) কোনো নিজস্ব রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী থাকতে পারে। বাংলাদেশে যথেষ্ট স্থিতিশীলতা আছে, তারপরও কেন তারা এটা করলো তা বোধগম্য নয়। ’
অবশ্য কথায় কথায় তিনি আরো বলেছেন,‘ তবে আমাদের নিরাপত্তায় নিয়োজিতদের আরো একটু পেশাদারিত্ব দেখাতে হবে। তারা দেখা যায় কালো গ্লাসের দামী গাড়িতে নিরাপত্তা চেক না করে রিক্সা বা সিএনজিতে নিরাপত্তা তল্লাশি চালিয়ে থাকে।’ ইশফাক মনে করেন আমাদের পররাষ্ট্র অফিসের যুক্তরাষ্ট্রের এ উদ্যোগ নিয়ে কথা বলা উচিত।
এর পরপরই আমি ফোন করি আরেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী সিকদার (অব)কে। তিনি একটি যৌক্তিক কথাই বলেছেন। তিনি বলেন ‘এই ‘সতর্কতা’ ইস্যুর পেছনে তাদের (যুক্তরাষ্ট্রের) কোনো নিজস্ব রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী থাকতে পারে। বাংলাদেশে যথেষ্ট স্থিতিশীলতা আছে, তারপরও কেন তারা এটা করলো তা বোধগম্য নয়। নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান রফতানির দেশ যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তাদের আচরণ সন্দেহের উদ্রেক করে বৈ কি।
২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় বাংলাদেশে তাদের আচরণ এবং তৎপরতায় মনে হয়েছে বিএনপির গলায় সুর মিলিয়ে কথা বলছেন। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকে মনে হতো বিএনপি’র স্ট্যান্ডিং কমিটির মেম্বার। তারও আগে যদি খতিয়ে দেখি, ২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন এসেছিলেন ইউনিকলকে বাংলাদেশের গ্যাস পাইয়ে দিতে। সেটা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেননি। তারও আগে গেলে আমরা দেখি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা। তারা যারপর নাই চেষ্টা করেছিল পাকিস্তানকে সমর্থন দিতে। তাছাড়া এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের একটি কৌশলগত নজর বহু আগে থেকেই আছে। যেখানে পাকিস্তানকে সতর্কতা দেওয়া হয় না সেখানে বাংলাদেশের ব্যাপারে সতর্ক করাটা উদ্দেশ্যহীন না।’
সত্যিই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যটা বোঝা মুশকিল। যেখানে তারা ট্রাভেল অ্যাডভাইজরিতে পাকিস্তানের ব্যাপারে সতর্কতা ইস্যু করেনি, সেখানে বাংলাদেশের ব্যাপারে করাটা কি কোনো যুক্তিতে মেনে নেওয়া যায়? বাংলাদেশ কি পাকিস্তানের চেয়েও ঝুঁকিপূর্ণ? প্রশ্ন থাকে কিন্তু।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক