বারবার আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে ফসল হারিয়ে এবার কিছুটা আগেভাগে বোরো ধান লাগিয়েছিল হাওর এলাকার কৃষকরা। কিন্তু আগাম লাগানো সেই ব্রি-২৮ জাতের ধান এখন আর পুষ্ট হচ্ছে না। নেত্রকোনার কলমাকান্দা, মোহনগঞ্জ,খালিয়াজুরী ও মদন উপজেলার হাওরে বোরো ধানে চিটা দেখা দিয়েছে ব্যাপক হারে। সুনামগঞ্জেরও দুই উপজেলায় বোরো ধানে আংশিক চিটা দেখা দিয়েছে।
এ ছাড়া অব্যাহত ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে হাওরপারের কৃষকরা। উঠতি বোরো ধান নিয়ে এমন বিপর্যয়ে তারা এখন দিশাহারা।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) কয়েকজন বিজ্ঞানী সম্প্রতি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরী, মদন ও কলমাকান্দা উপজেলার কয়েকটি হাওর পরিদর্শন করেছেন। তাঁরা জানান, নির্দিষ্ট সময়ের আগে বীজতলা তৈরি ও চারা লাগানোর কারণে ওই সব উপজেলার প্রায় ছয় হাজার হেক্টর জমির বোরো ধানের গাছ কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়েছে।
সরজমিনে ঘুরে দেখা যায়, কলমাকান্দা উপজেলার সবচেয়ে বড় হাওড় গোড়াডোবা , সোনাডুবি, মেদিকান্দাসহ প্রায়ই ১ হাজার হেক্টর বোরো ফসলে এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হাওরপাড়ের কৃষকদের অভিযোগ অজ্ঞাত রোগ সম্পর্কে মাঠ পর্যায়ে প্রতিরোধ ও সচেতনা বিষয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় কৃষি বিভাগ কর্তৃক কোন ধরণের মাইকিং বা কৃষকদের কে নিয়ে কাউন্সিলিং দৃশ্যমান হয়নি। যার ফলে দিশেহারা কৃষক।
বড়খাপন ইউপি’র চেয়ারম্যান একেএম হাদিছুজ্জামান হাদিছ বলেন “ গত বছরের বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার আগেই আবারও প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে এসেছে হাওড়ের কৃষকদের জীবনে। আমাদের দেশের হাওরাঞ্চলের কৃষকরা বন্যার আগে ফসল কেটে নিয়ে যেন গোলায় উঠাতে পারে সে ধরনের বীজ উদ্ভাবন করে কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আামি সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানায় ”।
খালিয়াজুরী কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ছয় ইউনিয়নে এবার ১৯ হাজার ৮৭০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়। এর মধ্যে চিটা হয়েছে পাঁচ হাজার হেক্টর জমির ফসলে। তবে স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রকৃত আক্রান্ত জমির পরিমাণ আরো বেশি। বিশেষ করে খালিয়াজুরীর পাঙ্গাশিয়া, কীর্তনখোলা, কটিচাপরা, সেনের বিল, জালর বন, সোনাতোলা, বল্লীর চৌতরা, জগন্নাথপুরের বড় হাওর, বাজজোয়াইল, পাঁচহাট, নগর, বোয়ালী, চাকুয়ার হাওরের কয়েক হাজার একর জমির ফসল চিটায় পরিণত হয়েছে।
নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, বারির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুহম্মদ আশিক, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. হীরেন্দ্র নাথ বর্মণ এবং উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের ড. তুহিনা খাতুন সম্প্রতি মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরী, কলমাকান্দা ও মদন উপজেলার বিভিন্ন হাওরে ক্ষতিগ্রস্ত বোরো জমি পরিদর্শন এবং কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁরা কৃষকদের কিছু পরামর্শও দেন।
তাঁরা বলেন, ২৯ থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত রাতে তাপমাত্রা ১০ থেকে ১২ ডিগ্রি এবং দিনে ২৫ থেকে ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকায় বীজতলা তৈরি ও চারা রোপণকালে বোরো ধানের চারা কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়। ফলে ধানে ব্যাপক আকারে চিটা দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে মদন উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা গোলাম রসুল বলেন, ‘এটা বীজের কোনো সমস্যা নয়, এটা হলো শীতজনিত সমস্যা।’
নেত্রকোনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. হাবিবুর রহমান হাওরাঞ্চলে বোরো ধানে চিটা দেখা দেওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ, মদন ও কলমাকান্দা উপজেলার হাওরে প্রায় ছয় হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়েছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
সুনামগঞ্জেও কিছু এলাকায় চিটা
সুনামগঞ্জের স্থানীয় কৃষি বিভাগের মতে, জেলায় এবার প্রায় ৩০ হেক্টর জমির ধান চিটায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সুনামগঞ্জ কৃষি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বিআর ২৮ ধান যারা ১৫ নভেম্বরের আগে রোপণ করেছে তাদের ধানই কিছু নষ্ট হয়েছে। তা ছাড়া সময়ে বৃষ্টি না হওয়া এবং রোপণের পর শীতও চিটা দেখা দেওয়ার কারণ।
তাহিরপুর উপজেলার প্রায় ২০ হেক্টরের মতো জমিতে চিটা দেখা দিয়েছে। অন্যান্য উপজেলায় তেমন চিটা দেখা দেয়নি। তবে কৃষকদের দাবি, জগন্নাথপুর উপজেলায়ও বিআর ২৮ ধানে চিটা দেখা দিয়েছে।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. বশির আহমদ সরকার বলেন, তাহিরপুর উপজেলার কিছু জমি ছাড়া অন্যত্র চিটার খবর পাওয়া যায়নি।