দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল কাস্টম হাউজে চলতি অর্থবছরের (২০১৮-১৯) জুলাই থেকে ২১ মে পর্যন্ত প্রায় ১১ মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় কম হয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, শুল্ক ফাঁকি ও কাস্টমে নানা নিয়ম কানুন জারি, হয়রানি বেড়ে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও বাণিজ্য তদারকিতে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর মধ্যে পরস্পরের সমন্বয় না থাকায় ব্যবসায়ীরা এ পথে বাণিজ্যে মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় সরকারের যেমন রাজস্ব আয়ে বাধাগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি লোকসান গুনেছেন ব্যবসায়ীরাও। হয়রানি বন্ধ আর বৈধ সুবিধা নিশ্চিত হলে আবার গতি ফিরবে বেনাপোল বন্দরে। অন্যদিকে কাস্টম কর্তৃপক্ষ বলছেন, শুল্কফাঁকি রোধে কড়াকড়ি আরোপ করায় আমদানি কমে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীদের বৈধ সুবিধাগুলো বাড়াতে তারা আন্তরিক হয়ে কাজ করছেন।
দেশে ২৩টি স্থলবন্দরের মধ্যে চলমান ১৩ বন্দরের সবচেয়ে বড় আর বেশি রাজস্ব দাতা বেনাপোল স্থলবন্দরের কাস্টম হাউজ। ১৯৭২ সাল থেকে এ পথে ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চলে আসছে। প্রতিবছর এ বন্দর দিয়ে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়ে থাকে। যা থেকে সরকারের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়। বন্দরে আমদানি পণ্যের ধারণ ক্ষমতা ৪২ হাজার মেট্রিক টন কিন্তু এখানে সার্বক্ষণিক পণ্য থাকে প্রায় দেড় লাখ মেট্রিক টন। বর্তমানে বন্দরে ২৮টি পণ্যাগার, ৮টি ওপেন ইয়ার্ড, একটি ভারতীয় ট্রাক টার্মিনাল, একটি রপ্তানি ট্রাক টার্মিনাল ও একটি ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ডের মাধ্যমে কাজ চলছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। বন্দরে জায়গার অভাবে খোলা আকাশের নীচে হাজার হাজার টন পণ্য রোদ বৃষ্টিতে নষ্ট হচ্ছে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেনাপোল কাস্টম হাউজে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ হাজার ১৯৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। আদায় হয়েছিল ৪হাজার ১৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এতে ঘাটতি ছিল ১৭৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেন ৫ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা। জুলাই থেকে ২১ মে পর্যন্ত প্রায় ১১ মাসে লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে ঘাটতি রয়েছে ১ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। ফলে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব পূরণ হচ্ছে না বেনাপোল কাস্টম হাউজে।
- আরও পড়ুন>> আজ ২য় মেঘনা-গোমতী সেতুর উদ্বোধন
বেনাপোলের একজন আমদানিকারক আসাদুল ইসলাম বলেন, কাস্টম কর্তৃপক্ষ প্রতিটি আমদানি পণ্য রাসায়নিক পরীক্ষার নামে ল্যাবে পাঠাচ্ছে। মাঝে মধ্যে টাকা না দিলে উল্টাপাল্টা রিপোর্ট দিচ্ছে। ঢাকায় ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হচ্ছে মাঝে মধ্যে। ঢাকায় একটি পণ্যের রাসায়নিক পরীক্ষা করতে সর্বনিম্নে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা লাগে। আর সময় লাগে ১৫ থেকে ২০ দিন। ফলে লাভতো হয় না উপরন্তু বেশি দিন পণ্য বন্দরে আটকে থাকায় ব্যাংকের সুদসহ আমদানি পণ্যের ব্যয় বেড়ে যায়। এদিকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজর থাকলে হয়রানি পোহাতে হত না। ঝামেলা এড়াতে এ পথে আমদানি কমিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী ইদ্রিস আলী বলেন, এক শ্রেণি ব্যবসায়ীরা শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। মাঝে মধ্যে ২/১ টি চালান আটকও হচ্ছে। এটাও রাজস্ব ঘাটতির অন্যতম কারণ। কাস্টম কর্তৃপক্ষ বর্তমানে অতীতের তুলানায় এতো বেশি কড়াকড়ি আরোপ করেছে যে ব্যবসায়ীরা অন্য বন্দরের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এছাড়া বৈধ আমদানি চালান কাস্টমস কর্তৃক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রাজস্ব আদায় করে ছাড় দেয়ার পর পথে সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ ছাড়া বিজিবি সদস্যরা ওই পণ্য আটক করছে। সেখানে ২/৩ দিন পণ্য চালান আটকে থাকছে। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিজিবি আর কাস্টমসের মধ্যে পরস্পরের সমন্বয় দরকার।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন জানান, ভারতের সঙ্গে অল্প সময়ে দ্রুত এ বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি করা যায় বিধায় সবাই ব্যবসা করতে চায়। কিন্তু অবকাঠামোগত উন্নয়ন সমস্যায় সুষ্ঠু বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সপ্তাহে ৭ দিন বাণিজ্য সেবা চালু থাকলেও ব্যবসায়ীরা তার সুফল পাচ্ছে না। বাণিজ্য প্রসার করতে হলে বৈধ সুবিধা প্রদান ও অবকাঠামো উন্নয়নের বিকল্প নেই।
বেনাপোল আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সহসভাপতি আমিনুল হক বলেন, বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন সমস্যা আর অনিয়মে বার বার অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে। কয়েকবার অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল বন্দরের নিরাপত্তায় সিসি ক্যামেরা স্থাপনের। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। এখন এ বন্দর দিয়ে ব্যবসায়ীরা আমদানি করতে ভয় পায়।
বেনাপোল কাস্টম হাউজের যুগ্ম কমিশনার শহীদুল ইসলাম জানান, পণ্য চালান খালাসে পূর্বের চেয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বেড়েছে কাস্টমে। শুল্ক ফাঁকি বন্ধে কড়াকড়ি আরোপ করায় কিছু ব্যবসায়ী এ বন্দর দিয়ে আমদানি কমিয়েছেন। বিশেষ করে রাজস্ব বেশি আসে এমন পণ্য চালান কম আমদানি হচ্ছে। এতে রাজস্ব কিছুটা ঘাটতি হয়েছে। তবে তারা চেষ্টা করে যাচ্ছেন তা পূরণের। শুল্কফাঁকির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে। ব্যবসায়ীদের বৈধ সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে তারা আন্তরিক হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন বলেও জানান তিনি।
বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ট্রাফিক) প্রদোষ কান্তি দাস জানান, বন্দরে সব ধরনের শৃঙ্খলা ফেরাতে কাজ করা হচ্ছে। জায়গা সংকটে বর্তমানে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তবে তারা নতুন জায়গা অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন কাজ শুরু করেছেন। সম্পূর্ণ হলে বেনাপোল বন্দরে সুষ্ঠুভাবে বাণিজ্য পরিচালনায় ব্যবসায়ীদের আর কোন অভিযোগ থাকবে না।