ফেনী থেকে প্রত্যাহার হওয়া পুলিশ সুপার (এসপি) জাহাঙ্গীর আলম সরকারের রোষানলে পড়ে ‘গায়েবি’ নয় মামলায় আসামি হওয়া চার সাংবাদিককে হয়রানি ও গ্রেফতার না করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে তাদের নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে।
ফেনীর আলোচিত মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের পর শরীরে আগুন দিয়ে হত্যার ঘটনায় সংবাদ প্রকাশ করেন স্থানীয় ওই চার সাংবাদিক। সংবাদ প্রকাশে অসন্তুষ্ট হয়ে তৎকালীন জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) জাহাঙ্গীর আলমের প্ররোচনায় তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করা হয়। ভুক্তভোগীরা এসব মামলাকে ‘গায়েবি’ বলে উল্লেখ করেন।
ছাগলনাইয়া থানায় ২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর ও ২৬ ডিসেম্বর, দাগনভূঁইয়া থানায় ২৭ ও ২৯ অক্টোবর, ফেনী মডেল থানায় ২, ৭ ও ৮ সেপ্টেম্বর এবং সোনাগাজী থানায় ৯ ফেব্রুয়ারি ও ১১ অক্টোবর দায়ের করা মামলায় তাদের আসামি করা হয়। এসব মামলার অধিকাংশই বাদী পুলিশ।
ভুক্তভোগী সাংবাদিকরা হলেন- দৈনিক ফেনীর সময় ও সাপ্তাহিক আলোকিত ফেনীর সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন, দৈনিক অধিকার প্রতিনিধি ও অনলাইন পোর্টাল ফেনী রিপোর্ট’র সম্পাদক এস এম ইউসুফ আলী, বাংলানিউজ-এর স্টাফ করসপন্ডেন্ট সোলায়মান হাজারী ডালিম এবং দৈনিক সময়ের আলো প্রতিনিধি ও দৈনিক স্টার লাইনের স্টাফ রিপোর্টার মাঈন উদ্দিন পাটোয়ারী।
সাংবাদিকদের পক্ষে করা জামিন আবেদনের শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. রিয়াজ উদ্দিন খানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এমন আদেশ দেন।
আদালতে জামিন আবেদনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ কামাল হোসেন, মো. মহসিন কবির, মো.আজিজুর রহমান ও এস এম সালেহ আহমেদ।
অভিযোগ রয়েছে, নুসরাত হত্যার রহস্য উদঘাটন ও সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা তুলে ধরতে সক্রিয় ভূমিকা পালনের কারণে এসপি জাহাঙ্গীর অনৈতিকভাবে ‘খেদ মিটিয়েছেন’ পেশাদার সাংবাদিকদের ওপর। সেই থেকে তাদের বিরুদ্ধে এমন মামলা।
উল্লেখ্য, গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলার হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হন ওই প্রতিষ্ঠানের আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত। সেদিনই স্থানীয় জনতা অধ্যক্ষকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেন। এ ঘটনায় রাফির মা শিরীন আক্তার বাদী হয়ে থানায় অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। তবে, মামলা প্রত্যাহার করতে নুসরাত ও তার পরিবারকে হুমকি-ধমকি দেন অধ্যক্ষের সহযোগীরা। একপর্যায়ে ৬ এপ্রিল পরীক্ষার পূর্ব মুহূর্তে মাদরাসার ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ এপ্রিল মৃত্যু হয় নুসরাতের।
প্রথমে ঘটনাটিকে ‘আত্মহত্যা’ বলে প্রচার করেন সোনাগাজী মডেল থানার প্রত্যাহার হওয়া ওসি (বর্তমানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতার) মো. মোয়াজ্জেম হোসেন। তার পক্ষে অবস্থান নেন পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকার। ঘটনাটি নিয়ে যখন দেশ-বিদেশের সব গণমাধ্যমে সাংবাদিকরা সরব হয়, এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন নুসরাতের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারে নির্দেশ দেন, তখনও বিস্ময়কর নির্লিপ্ততা দেখান এসপি জাহাঙ্গীর সরকার। সোনাগাজীতে পর্যন্ত যাননি তিনি।
মামলায় সিরাজ উদ-দৌলাসহ কয়েকজনকে আসামি করতে এসপি-ওসি টালবাহানা করেন বলে নুসরাতের পরিবারের পক্ষ থেকে তখন অভিযোগ ওঠে। শুধু তাই নয়, পুলিশ সদরদফতরেও তিনি (এসপি) ওসির পক্ষে সাফাই গেয়ে চিঠি লিখেন। তাদের পক্ষপাতমূলক ভূমিকা প্রকাশ পেলে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
মামলাটি পিবিআইতে স্থানান্তরের পর ঘটনায় জড়িতরা একে একে গ্রেফতার হতে থাকেন। বেরিয়ে আসে ঘটনার মূল রহস্য। একপর্যায়ে পুলিশ সদরদফতরের তদন্তে এসপি-ওসিসহ চার পুলিশ কর্মকর্তা দোষীসাব্যস্ত হন। ওসি মোয়াজ্জেমকে বরখাস্ত করে রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়। আর এসপি জাহাঙ্গীর সরকারকে প্রত্যাহার করে সংযুক্ত করা হয় পুলিশ সদরদফতরে। অপর দুজনকেও প্রত্যাহার করে পার্বত্য এলাকায় সংযুক্ত করা হয়।
জেলা পুলিশের বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এসপি জাহাঙ্গীর ফেনী ছাড়ার আগেই কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। এ সময় তিনি এ ঘটনায় তাকে নিয়ে গণমাধ্যমের ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে কয়েকজন সাংবাদিককে হেনস্থা করার পরিকল্পনা নেন। তাদের নাম সংবলিত একটি তালিকা সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের ধরিয়ে দেন। বিভিন্ন তদন্তাধীন মামলায় সেই সাংবাদিকদের নাম চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দেন। কয়েকজন ওসি কৌশলে এড়িয়ে গেলেও অন্যদের এসিআর আটকে রাখার ভয় দেখিয়ে আদালতে চার্জশিট দাখিলের জন্য চাপ দেন এসপি জাহাঙ্গীর সরকার।
গত ১২ মে সন্ধ্যায় তার বদলি আদেশ আসার পর তিনি রাতে জরুরি ভিত্তিতে ওসিদের ডেকে চাপ প্রয়োগ করে কয়েকটি চার্জশিট তৈরি করান এবং পরদিন তা দাখিলে বাধ্য করেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ওসি জানান। এমনকি বিষয়টি গোপন রাখতেও কোর্ট পরিদর্শকসহ অন্যদের নির্দেশ দেন এসপি।