মৃত্যুর আগে বারবার দেশে ফিরতে চেয়েছিলেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনের গেরিলা যোদ্ধা এবং বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা। বাবার শেষ ইচ্ছার কথা জানাতে ছেলে প্রকৌশলী ইশরাকে হোসেন জানাতে রোববার সকালে ফোন করেছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে।
রোববার রাজধানীর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে এক দোয়া অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব খোকার শেষ ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেন। তবে আর তার জীবিত ফেরার সুযোগ রইল না। নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় রবিবার দিবাগত মধ্যরাতে ম্যানহাটনের মেমোরিয়াল স্লোয়ান ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টারে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন খোকার মৃত্যু হয়েছে।
নিউইয়র্কে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাংলাদেশ সময় আজ বেলা ১টার সময় তিনি ইন্তেকাল করেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস উইং সদস্য শায়রুল কবির খান যুগান্তরকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
মির্জা ফখরুল খোকার শেষ ইচ্ছার কথা জানিয়ে বলেন, রোববার সকালে সাদেক হোসেন খোকার ছেলে আমাকে ফোন করে বলেছেন, তার বাবার ইচ্ছাটা সে পূরণ করতে চায়। তিনি যেন দেশে ফিরতে পারেন তার উদ্যোগ নিতে আমরা সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছি।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গেও একাধিকবার খোকা দেশে ফেরার আকুতি জানিয়েছেন। কিছু দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগেও বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান টুকুর সঙ্গে ফোন করে দেশে আসার আকুতির কথা জানিয়েছেন।
সেটি স্মরণ করে রোববার দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে খোকার জন্য দোয়া মাহফিলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আজকে যখন আমরা স্বৈরাচার ও একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করছি, তখন সাদেক হোসেন খোকাকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে দেশের বাইরে রাখা হয়েছে। তিনি ক্যান্সার রোগে ভুগছেন। চিকিৎসার জন্য বিদেশে অবস্থান করছেন। আমি কয়েকবার তার সঙ্গে নিউইয়র্কে দেখা করেছি। প্রতিবারই তিনি আমাকে বলেছেন- যদি অসুস্থ না হতাম, তা হলে আমি দেশে গিয়ে জেলে যেতাম, মানুষের সঙ্গে থাকতাম।’
তিনি বলেন, সাদেক হোসেন খোকা আমাদের ও তার বন্ধুদের বলেছেন যে, ‘দেশের মাটিতেই যেন আমার কবর হয়’।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসনের যাঁতাকলে পড়ে শুধু সাদেক হোসেন খোকা নন, আমাদের অনেক মানুষ এখন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং অনেকেই এখন শেষ পর্যায় চলে এসেছেন। আমাদের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ও শাজাহান সিরাজ সাহেব অত্যন্ত অসুস্থ। আমাদের যারা বয়স্ক মানুষ আছেন, তারা এখন অসুস্থ হয়ে পড়ছেন দেশের এই অবস্থার কারণে।’
এদিকে হাসপাতালে যাওয়ার আগে সাদেক হোসেন খোকা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে আক্ষেপ করে বলেছেন, জীবনবাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। দেশের মাটিতে বিদায় হবে কিনা আল্লাহ জানেন। আমার জন্য দোয়া করো।
এদিকে সাদেক হোসেন খোকার অবস্থা সংকটাপন্ন শুনে ভেঙে পড়েছেন তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তার সুস্থতা কামনায় একটি আবেগঘন খোলা চিঠি লিখেছেন। সেটি নিজের ফেসবুক ওয়ালে দিয়েছেন মির্জা আব্বাস। এই চিঠি হৃদয় ছুঁয়ে গেছে বিএনপির নিযুত নেতাকর্মীদের। খোলা চিঠিতে মির্জা আব্বাস লিখেছেন, সুস্থ হয়ে ফিরে এসো খোকা, ফিরো এসো। আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব।
মির্জা আব্বাস লিখেছেন, ‘প্রিয় খোকা, এই মাত্র আমি খবর পেলাম যে, তোমার শরীর খুব খারাপ। তুমি হাসপাতালে শয্যাশায়ী। জানার পর থেকে আমার মানসিক অবস্থা যে কতটা খারাপ, এই কথাটুকু কারও সঙ্গে শেয়ার করব, সেই মানুষটা পর্যন্ত আমার নেই। তুমি-আমি একসঙ্গে রাজনীতি করেছি, অনেক স্মৃতি আমার চোখের সামনে এই মুহূর্তে ভাসছে।’
স্বার্থান্বেষীরা তাদের মধ্যে বিরোধ জিইয়ে রেখেছে উল্লেখ করে মির্জা আব্বাস লিখেছেন, ‘তোমার আর আমার দীর্ঘ এই পথচলায় কেউ কেউ তাদের ব্যক্তি স্বার্থে তোমার আর আমার মাঝে একটা দূরত্ব তৈরি করে রেখেছিল। তবে তুমি আর আমি কেউই সেই দূরত্বে রয়েছি বলে আমি কখনোই মনে করিনি।’
খোকার দুঃসময়ে পাশে না থাকতে পারার আক্ষেপ প্রকাশ করে মির্জা আব্বাস লিখেছেন, ‘আমি জানি না, তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে কিনা? আমার এ লেখাটি তোমার চোখে পড়বে কিনা বা তুমি দেখবে কিনা, তাও আমি জানি না। তবে বিশ্বাস কর, তোমার শারীরিক অসুস্থতার কথা জানর পর থেকেই বুকের ভেতরটা কেন যেন ভেঙে আসছে।’
খোকার সুস্থতার কামনা করে আব্বাস লিখেছেন, ‘আমি বারবার অশ্রুসিক্ত হচ্ছি। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে দুহাত তুলে তোমার জন্য এই বিশ্বাস নিয়ে দোয়া করছি- তিনি অবশ্যই তোমাকে সুস্থ করে আমাদের মাঝে ফিরে আনবেন।’
আবার একসঙ্গে পথচলার আশাবাদ ব্যক্ত করে আব্বাস লিখেছেন, ‘তুমি আর আমি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, বুকে বুক মিলিয়ে রাজনীতির মাঠে কাজ করে যাব। না হয় সেই আগের মতোই স্বার্থপর কোনো মানুষদের জন্য আব্বাস আর খোকা বাইরে বাইরে দূরত্বের সেই অভিনয়টা করে যাবে, আর ভেতরে থাকবে দুজনের প্রতি দুজনের অন্তর নিংড়ানো ভালোবাসা।’
‘আল্লাহ তোমার সুস্থতা দান করুক। তুমি ফিরে এসো খোকা, তুমি ফিরে এসো। আমি অপেক্ষায় থাকব’-যোগ করেন আব্বাস।
খোকার জীবনের শেষ ইচ্ছানুযায়ী অন্তিম সময়ে তাকে দেশে নেয়াও পরিবারের পক্ষে সম্ভব হয়নি। পাসপোর্ট না থাকায় দেশে ফিরতে পারেননি তিনি। পরবর্তী সময়ে কী হবে, এ নিয়ে স্বজনরা বিভ্রান্তিতে আছেন।
ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য ২০১৪ সালের ১৪ মে সপরিবারে নিউইয়র্ক চলে যান সাদেক হোসেন খোকা। তার পর থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিউইয়র্ক সিটির কুইন্সে একটি বাসায় দীর্ঘদিন ধরে থাকছিলেন বিএনপির এ নেতা।
ভিজিট ভিসার নিয়ম অনুযায়ী, ছয় মাস পর পর যাওয়া-আসা করে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বৈধ রাখার নিয়ম। ২০১৭ সালে খোকা ও তার স্ত্রী ইসমত হোসেনের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। তারা নিউইয়র্ক কনস্যুলেটে নতুন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নতুন পাসপোর্ট পাওয়ার ব্যাপারে কনস্যুলেট থেকে কোনো সদুত্তর দেয়া হয়নি।
- আরও পড়ুন >> ঢাকা সিটির সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা আর নেই
২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন খোকা। ২৯ নভেম্বর ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা ১০ বছর বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শাসনামলে ঢাকা মহানগরের মেয়র ছিলেন তিনি। ২০১৪ সালের ১৪ মে মাসে সাদেক হোসেন খোকা চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যান। সেখানেই চিকিৎসাধীন আছেন। এ সময়কালে দেশে তার বিরুদ্ধে কয়েকটি দুর্নীতি মামলা হয়। এর কয়েকটিতে তাকে সাজাও দেয়া হয়েছে।