বিএনপি ছাড়লেন মাহবুবুর রহমান

মাহবুবুর রহমান।
মাহবুবুর রহমান। ফাইল ছবি

রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান। তিনি দলের সব ধরনের পদ থেকে অব্যাহতি চেয়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বরাবরে লেখা চিঠি পৌঁছে দিয়েছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে।

সাবেক এই সেনাপ্রধান বুধবার রাতে গণমাধ্যমকে পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন। দু মাস আগেই তিনি মহাসচিবকে পদত্যাগের চিঠি দিয়েছেন বলে জানান মাহবুব।

তিনি বলেন, আমি রাজনীতি থেকে সরে এসেছি। আমি রিজাইন করেছি দল থেকে। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও প্রাথমিক সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নিয়েছি দেড়-দু’মাস আগে।

কী কারণে পদত্যাগ করেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কারণ আমি বয়স্ক মানুষ। সামনের ডিসেম্বরে ৮০ বছর পূর্ণ হবে। রাজনীতিতে কনট্রিবিউট করার মতো আমার কিছু নেই।

মাহবুবুর রহমান পদত্যাগের কারণ হিসেবে বয়সের কথা বললেও এর নেপথ্যে আরও কারণ রয়েছে। মূলত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের মতের সঙ্গে তার মত মিলছিল না। বিদেশ থেকে তারেক রহমানের দল পরিচালনার সমালোচক তিনি। এছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের বিরোধী ছিলেন এই জ্যেষ্ঠ নেতা। বিএনপির জোটের রাজনীতির সমালোচকও মাহবুব। তিনি জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোট মেনে নিতে পারছিলেন না। এসব কারণে গত কয়েক মাস ধরে তিনি বিএনপির স্থায়ী কিমিটির সভায় অনিয়মিত ছিলেন। এরই ধারবাহিকতায় দল ছাড়েন মাহবুব।

বিগত কয়েক বছরে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, মোসাদ্দেক আলী ফালু, ইনাম আহমেদ চৌধুরীর পর মঙ্গলবার বিএনপি ছাড়েন আরেক ভাইস চেয়ারম্যান এম মোরশেদ খান। মাহবুবুর রহমানের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের কেউ প্রথমবারের মতো দল ছাড়লেন।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, লন্ডনে এক সভায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান (তারেক রহমান) জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী জাতির পিতা আখ্যা দিয়ে এর সমর্থনে নেতাকর্মীদের কাছে প্রস্তাব রাখেন। এ সময় সভায় উপস্থিত নেতাকর্মীরা তারেক রহমানের প্রস্তাব কণ্ঠভোটে সমর্থন করেন। পরে বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠে এলে এ বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন মাহবুবুর রহমান।

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি দলের স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে চারজন নেতা মাহবুবুর রহমানের দ্বিমত করার বিষয়টি উত্থাপন করেন। এ নিয়ে ওই বৈঠকে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হওয়ার পর সিদ্ধান্ত হয়, মাহবুবুর রহমান যেন তার দ্বিমতের বক্তব্যের বিষয়ে লিখিতভাবে দুঃখ প্রকাশ করেন।

দু’দিন পর এ বিষয়ে জানতে স্থায়ী কমিটির এক সদস্য মাহবুবুর রহমানের বাসায় গেলে তিনি তার দ্বিমত পোষণের বক্তব্যে অনড় থাকার কথা জানিয়ে দেন। এরপরই তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন।

অবশ্য বুধবার রাতে মাহবুবুর রহমান পদত্যাগের বিষয়টি স্বীকার করার এক ঘণ্টা পর আবার ফোন দিলে ফোন রিসিভ করেন তার স্ত্রী। তিনি তখন বলেন, মাহবুবুর রহমান অসুস্থ। এ জন্য দীর্ঘদিন থেকে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে নেই। দলীয় কোনো কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। তবে তার পদত্যাগের বিষয়টি সঠিক নয়।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সূত্র আরও জানায়, মাহবুবুর রহমানের পদত্যাগের পেছনে অন্যতম কারণ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সরাসরি বিরোধিতা করা। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি একাধিক অনুষ্ঠানে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিয়ে মন্তব্য করেন। যদিও এরপর সাবেক এই সেনাকর্মকর্তা স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অংশ নিতেন।

গত জানুয়ারিতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে মাহবুবুর রহমান অভিযোগ করেন, একাদশ নির্বাচনে গিয়ে বিএনপি ভুল করেছে। যদি দলের নেতৃত্ব দিতে হয়, তারেক রহমানকে দেশে আসতে হবে। দেশে এসেই তাকে নেতৃত্ব দিতে হবে। বিদেশ থেকে দলের নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব নয়।

২০১৯ সালে বইমেলায় লেখক মহিউদ্দিনের ‘এক-এগারো বাংলাদেশ ২০০৭-২০০৮’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। সেই বইয়ে মাহবুবুর রহমানের একটি সাক্ষাৎকার আছে। সেখানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্পর্কে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘১/১১-এর পরে বিএনপিতে ইনিশিয়ালি আমার একটু অসুবিধা হয়েছিল। যা-ই হোক, দল আন্ডারস্টুড মাই পজিশন। দল মানে খালেদা জিয়া। তারেক স্টিল নট হ্যাপি মাই পজিশন।’ এই সাক্ষাৎকারে তারেক রহমানকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব করা প্রসঙ্গে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘গ্র্যাজুয়াল মুভ করা হলে এক জিনিস। কিন্তু একেবারে সিনিয়র জয়েন্ট সেক্রেটারি? এটা একটা ব্লানডার!’

মাহবুবুর রহমান বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের জোট নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন একাধিকবার। গত জানুয়ারিতেই গণমাধ্যমে তিনি বলেন, ‘এমন কোনও দলের সঙ্গে বিএনপির জোট করা উচিত নয়, যে দলের নীতি-আদর্শ সম্পূর্ণ বিপরীত। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য করতে পারে না। বিএনপির উচিত জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা। এ ক্ষেত্রে আমি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেনের অবস্থানকে সমর্থন করি। জামায়াত বিএনপির শক্তি নয়, বোঝা।’ বিএনপি কেন বোঝা বহন করে চলবে, নেতাকর্মীরা এমনটি মনে করে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন মাহবুবুর রহমান। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নে দিনাজপুর-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই আসন থেকে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর কাছে পরাজিত হন। সবশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেননি মাহবুব।

১/১১ সময় বিএনপির সংস্কারবাদীদের একজন ছিলেন মাহবুবুর রহমান। এর জেরে দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা তাকে মানিক মিয়া এভিনিউতে ধাওয়া দিয়েছিলেন। অভিযোগ আছে, কয়েকজন কর্মী তার গায়েও হাত দেয়। যদিও পরে ডেকে এনে তাকে দলে পদ দেন খালেদা জিয়া।

রাজনীতি থেকে পদত্যাগের কারণ উল্লেখ করে মাহবুবুর রহমান বলেন, আমি রাজনীতি নিয়ে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছি। বাংলাদেশে রাজনীতি নেই। এখানে কোনো আদর্শও নেই। এখানে রাজনীতির নামে একটা এক্সপ্লয়টেশন চলছে। একটা তোষামোদ, ধাপ্পাবাজি ও মিথ্যাচারিতা চলছে।

অবসরের চিঠি কোথায়, কার কাছে দিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে মাহবুবুর রহমান বলেন, খালেদা জিয়ার কাছে তো পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। আমি চিঠি দিয়েছি মহাসচিব বরাবর।

চিঠি দেয়ার পর দলের প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মহাসচিব কিছু বলেননি। তার সঙ্গে বিস্তারিত কথাও বলিনি। জাস্ট চিঠি দিয়েছি। চিঠি পেয়েছেন কি না, তাও জানি না। আমি গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে চিঠি দিয়েছি। আমি নিজেই দিয়েছি। কথাও বলেছি। হাতে লেখা চিঠি দিয়েছি। কোনো কপি রাখিনি।

এ বিষয়ে জানতে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও বিএনপির মহাসচিবকে পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আমি পদত্যাগের বিষয়টি জানি না।

মঙ্গলবার ক্ষোভ ও অভিমানে ভাইস চেয়ারম্যান এম মোরশেদ খান বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন। এরপরই মাহবুবুর রহমানের পদত্যাগের খবরটি এল।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে