সাধারণ মানুষ ব্যবস্থাপনাকে ব্যবসা প্রশাসন ইনস্টিটিউটের অঙ্গীভূত বিষয় মনে করে। আবার অনেকে একে কমার্স ফ্যাকাল্টির একটি বিভাগ মনে করে। সব কিছু মিলে সাধারণ্যে যে ধারণাটি রয়েছে, তা হলো ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের জন্য ব্যবস্থাপনাবিষয়ক জ্ঞান প্রয়োজনীয়। সেদিক থেকে ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, করপোরেট হাউস, বহুজাতিক কম্পানির কর্মকর্তারা ব্যবস্থাপনা বিষয়ে শিক্ষা-প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে উপকৃত হতে পারেন। তাঁদের জন্য ব্যবস্থাপনার জ্ঞান প্রাসঙ্গিক। পক্ষান্তরে কবি-সাহিত্যিক, গায়ক, বাদক, গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা, চিত্রকর প্রমুখ গুণধর ব্যক্তিরা সুকুমার বৃত্তে অবস্থান করেন। ব্যবস্থাপনার মতো নীরস ও বিদঘুটে বিষয়টি তাঁদের মন-মেজাজের সঙ্গে যায় না। তাঁদের অভিরুচির সঙ্গে মেলে না। খেলোয়াড়, ক্রীড়াবিদ, ব্যায়ামবীর, ম্যাজিসিয়ানদের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য। ব্যবস্থাপনার কথা শুনলে তাঁরা কখনো নাক সিটকান, কখনো ভয় পেয়ে আলোচনা দ্রুত অন্য বিষয়ে ধাবিত করেন। তাঁরা মনে করেন, ব্যবস্থাপনার বিষয়টি সুকুমার বৃত্তের বাইরের কিছু কাঠখোট্টা লোক দেখবেন। এ বিষয়ে তাঁরা মাথা খাটাতে বা সময় নষ্ট করতে রাজি নন। তাঁরা ব্যস্ত থাকবেন মাঠে-ময়দানে, মঞ্চে, স্টুডিওতে ও প্রদর্শনীতে। তাঁদের কর্মশৈলীতে দর্শক, শ্রোতা, বিদগ্ধ ব্যক্তিরা মুগ্ধ হবেন।
তাঁরা হয়তো খেয়াল করেননি যে ব্যক্তির জীবনে তার মূল পেশা বা প্রধান কর্মানুশীলনের বাইরে এমন কিছু ব্যাপার রয়েছে, যাকে কোনোভাবে অবহেলা-উপেক্ষা করা যায় না। কবি-সাহিত্যিক, চিত্রকর, শিল্পী সবাইকে সুস্থ থাকতে হয়। সে কারণে তাঁদের শরীরের প্রতি যত্ন নিতে হয়, ছোটখাটো ব্যায়াম করতে হয়, হাঁটাচলা করতে হয় এবং প্রয়োজনবোধে ডাক্তারদের কাছে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। কবি-সাহিত্যিক, বিনোদনশিল্পী বলে রোগ-শোক কাউকে ছাড় দেবে না। রোগাক্রান্ত হলে গুণী শিল্পীও কাবু হয়ে পড়বেন। শিল্প-সাহিত্য ছেড়ে কর্মহীন অবস্থায় বিছানায় পড়ে থাকবেন। অন্যের সাহায্য-সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বেন। একইভাবে শিল্পী-সাহিত্যিক যে অর্থ উপার্জন করেন তার ওপর তাঁদের আয়কর দিতে হয়। এটি বাধ্যতামূলক। কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, খেলোয়াড় সবাইকে তাই বছরের আয়-ব্যয়ের ওপর একটি গ্রহণযোগ্য মানের হিসাব রাখতে হয়, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র সংরক্ষণ করতে হয়। তাদের আয়কর উপদেষ্টা বিশদ তথ্যাদি সংগ্রহ ও সংকলন করে আয়কর রিটার্ন প্রস্তুত করবেন। ফান্ড ম্যানেজার বা বেতনভুক হিসাবরক্ষক না থাকলে গুণী ব্যক্তিদের নিজ দায়িত্বে আয়-ব্যয়সংক্রান্ত মোটা দাগের হিসাব রক্ষণের ভার বহন করতে হবে। ফান্ড ম্যানেজার বা হিসাবরক্ষক থাকলেও তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করে আয়-ব্যয়ের অবস্থা সম্পর্কে একটি মানোত্তীর্ণ ধারণা রাখতে হবে। অন্যথায় বড় রকমের গাফিলতি হয়ে যেতে পারে এবং সে জন্য উপার্জনকারী শিল্পী, সাহিত্যিক, খেলোয়াড়কে বড় রকমের খেসারত দিতে হতে পারে, যার জন্য জীবনভর তিনি অনুতাপ বয়ে বেড়াবেন। তাঁর পেশাগত জীবনও বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। আপনি জ্ঞানী-গুণী, ধনকুবের কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত, যেই হোন না কেন, আপনাকে ব্যবস্থাপনার মৌলিক বিষয়গুলো জানতে হবে এবং ব্যক্তিগত জীবনে অল্প-বিস্তর সেই জ্ঞান-শিক্ষণ প্রয়োগ করতে হবে। পছন্দ না করলেও ব্যবস্থাপনাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করলে বা এড়িয়ে চললে আপনি অবশ্যই বিপাকে পড়বেন।
আপাত বিবেচনায় ব্যবস্থাপনাকে বিদঘুটে ও নীরস মনে হলেও নির্মোহ মনে পর্যালোচনা করলে প্রায়ই এর নান্দনিক রূপ চোখে পড়বে। সুব্যবস্থাপনা আমাদের জীবনকে সুন্দর করে, আমাদের কার্যাবলিকে সহজ করে এবং চলার পথকে সুগম করে। ব্যবস্থাপনার গুণে পদস্থ ব্যক্তিরা যেসব সুবিধা ও আনন্দ ভোগ করেন তার প্রতি তাঁদের এমন আসক্তি ও নির্ভরশীলতা জন্মায় যে এগুলো হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় তাঁরা পদ-পদবি ছাড়তে চান না। ব্যবস্থাপনার কৌশল খাটিয়ে তাঁদের পূর্বসূরিরা হয়তো এসব সুবিধা ভোগ-উপভোগের ব্যবস্থা করে গেছেন। তাঁরা উপকারভোগী হয়ে সে সুবিধাগুলো উপভোগ করেন। ব্যবস্থাপনার কৌশলগুলো উদ্ভাবিত না হলে তাঁরা কোনো দিন এসব সুবিধা ও আনন্দ ভোগ-উপভোগ করতে পারতেন না।
কোনো কাজ ভালোভাবে করতে হলে, কোনো কর্মসূচি সন্তোষজনকভাবে সুসম্পন্ন করতে হলে ব্যবস্থাপনার উপাদানগুলো সঠিকভাবে প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। শিল্পী, সাহিত্যিক, খেলোয়াড়ের মতো অনেক রাজনীতিবিদ মনে করেন তাঁরা মানুষের ভিড়ে সময় কাটান, এলাকার সমস্যা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে সারা দিন ব্যস্ত থাকেন। ব্যবস্থাপনার প্যাঁচালো বিষয়াদি বোঝার এবং সামাল দেওয়ার সময় ও সামর্থ্য তাঁদের নেই। এসব ঝামেলার মধ্যে তাঁদের টেনে আনা ঠিক হবে না। তাঁরা মানুষকে নিয়ে মানুষের জন্য অথবা এলাকার জন্য কাজ করবেন। ব্যবস্থাপনার প্যাঁচালো জিনিসপত্র দেখার জন্য অন্য লোক থাকবেন। তাঁরাই মূলত ব্যবস্থাপনা-সম্পৃক্ত বিষয়াদি সামাল দেবেন। রাজনীতিবিদরা তাঁদের হুকুম দেবেন এবং মাঝেমধ্যে তাঁদের দেখানো জায়গায় সই-স্বাক্ষর দেবেন। ব্যবস্থাপনার প্যাঁচে একবার জড়িয়ে পড়লে তাঁরা আর বেরোতে পারবেন না। এই জালে জড়িয়ে হাবুডুবু খাবেন। অতএব ব্যবস্থাপনার মারপ্যাঁচ থেকে দূরে থাকা হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
এরূপ ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদরাও কালাতিপাত করছেন। টাকা-পয়সার হিসাব, আইন-কানুনের বাধা-নিষেধ, বক্তব্য উপস্থাপনে, চলনে-বলনে সংযম ও সতর্কতার অনুশাসন তাঁদের ধাতে সয় না। ফলাফল হতে পারে ভয়ংকর শোচনীয়। আয়-ব্যয় সম্পদের হিসাব দিতে না পারা, এমনকি এর সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য বক্তব্য উপস্থাপন করতে না পারাকে এতদ্সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার লোকজন সহজভাবে নিতে পারেন না। তাঁরা ব্যাপারটিকে সন্দেহের চোখে দেখেন এবং এর মধ্যে অনৈতিক লেনদেন তথা দুর্নীতির গন্ধ খুঁজে পান। তাঁরা রাজনীতিবিদদের বিপক্ষে বিরূপ প্রতিবেদন দাখিল করেন। রাজনীতিবিদকে নিয়ে টানা-হেঁচড়া শুরু হয়। বিপাকে পড়ে তিনি বুঝতে পারেন আয়-সম্পদ ব্যবস্থাপনাকে অবজ্ঞা-উপেক্ষা করে এবং এ ব্যাপারে পুরোপুরি উদাসীন থেকে তিনি কত বড় ভুল করেছেন। এ ভুলের খেসারত কত বিশাল হতে পারে এবং কত দিন ধরে এর জের টানতে হবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
রাজনীতিবিদ অথবা অন্য কোনো ব্যক্তি যদি রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন, তখন ব্যবস্থাপনাবিষয়ক জ্ঞান ও দক্ষতা হবে সুষ্ঠুরূপে কর্ম সম্পাদনের জন্য তাঁর প্রধান হাতিয়ার। এখানে খেয়াল-খুশিমতো অথবা হাতের আন্দাজে কাজ করে তিনি বেশিদূর এগোতে পারবেন না। ব্যবস্থাপনার মৌলিক রীতিনীতি তাঁকে রপ্ত করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে তাঁর মন্ত্রণালয় বা সংস্থার পরিধি, তাঁর নিজের কর্মবৃত্তান্ত, মন্ত্রণালয় বা সংস্থার গঠন কাঠামো বা গঠনতন্ত্র, কর্মপরিচালনার প্রক্রিয়া, কর্মচারী শৃঙ্খলার অত্যাবশ্যকীয় নিয়ম-কানুন, আর্থিক নিয়ম-কানুন বিশেষ করে বাজেট নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক জ্ঞান, সংগ্রহ ও ক্রয়ের প্রাথমিক নিয়ম-কানুন। সর্বোপরি আন্ত মন্ত্রণালয় বা আন্ত সংস্থা সম্পৃক্ত আলোচনার আবশ্যকতা এবং এতদ্সংক্রান্ত রীতিনীতি তাঁকে ভালোভাবে জানতে হবে। তাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া যাতে একতরফা, কর্তৃত্ববাদী না হয়ে যৌক্তিক, ন্যায়াচরণভিত্তিক ও অংশীজনের চাহিদা ও মতামতের ভিত্তিতে নির্মিত হয় সে ব্যাপারে তাঁকে মনোযোগী হতে হবে। মানসিক সম্প্রতিভতা বজায় রেখে সতর্কতার সঙ্গে কাজ করাকে তাঁর অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। ব্যবস্থাপনার মৌলিক শিক্ষাকে দূরে সরিয়ে শুধু হাসিখুশি, আনন্দ-আলসেমিতে দিন কাটালে তা পরিণামে তার জন্য বিপত্তি ডেকে আনবে।
গত কয়েক বছরের কিছু ঘটনা নির্ভুলভাবে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে যে আমাদের অনেক পদস্থ কর্তাব্যক্তির চিন্তাচেতনা ও আচার-আচরণে ব্যবস্থাপনা জ্ঞান-দক্ষতার দারুণ ঘাটতি রয়েছে। দেশের খাদ্যগুদাম খালি হয়ে গিয়েছিল, অথচ কর্তাব্যক্তিরা তা ঠিক সময়ে জানতে পারেননি। খাদ্যশস্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁরা অন্ধকারে রইলেন। অথচ খাদ্য মজুদের নিয়মিত রিপোর্ট তাঁদের কাছে আসার ব্যবস্থা রয়েছে। নিশ্চয়তা এসেছে। কিন্তু তাঁরা তাতে দৃষ্টিপাত করেননি; অথবা চোখে দেখলেও তাতে গা করেননি। এরূপ একটি স্পর্শকাতর তথ্য তাঁদের উপলব্ধিকে এড়িয়ে গেছে। তাঁদের প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থাপকসুলভ ছিল না। খাদ্যশস্যের দাম যখন আকাশচুম্বী হয়েছে, সংকট যখন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে, তখন তাঁরা বুঝতে পেরেছেন যে কোথাও একটা বড় রকমের ভুল হয়ে গেছে। তত দিনে ভোক্তাসাধারণের নাভিশ্বাস উঠেছে। সরকারের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। এর পরও খাদ্যশস্য সংগ্রহের ব্যাপারে একইরূপ বিপত্তি দেখা দিল। খাদ্যশস্য যে সন্তোষজনক মাত্রা ও গতিতে সংগৃহীত হচ্ছে না, কর্তৃপক্ষ যথাসময়ে তা বুঝতে পারল না। নির্ধারিত সময়ের প্রায় শেষদিকে এসে তারা বুঝতে পারল যে সংগ্রহ কর্মসূচি ব্যর্থ হয়েছে। তারা দুঃখ প্রকাশ করল, তবে তা কোনো কাজে এলো না।
মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সোনার পদক দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। পদক দেওয়া হলে তা পরীক্ষা করে দেখা গেল এতে যে পরিমাণ খাদ মেশানো হয়েছে কোনো রকমে তা গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারের মান-সম্মান ভূলুণ্ঠিত হলো, বিশ্বের কাছে আমাদের মাথা হেঁট হয়ে গেল। ব্যবস্থাপনার প্রাথমিক শিক্ষা বলবে মন্ত্রণালয় কর্তৃক পদক গ্রহণের প্রাক্কালে পারদর্শী ব্যক্তি বা দল দিয়ে নির্ভুলভাবে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা আবশ্যকীয় ছিল। মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা কেন এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করলেন না তা বোধগম্য নয়। এ ব্যাপারে তদন্ত রিপোর্ট এখনো প্রকাশ হয়নি। হলে জানা যেত ব্যবস্থাপনার কী ধরনের ঘাটতি এখানে ঘটেছিল।
একই মন্ত্রণালয়ের ত্রুটিপূর্ণ রাজাকার তালিকা প্রকাশের ঘটনা জাতিকে হতভম্ব করেছে। এখন স্বরাষ্ট্র ও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় একে অপরকে দোষারোপ করছে। এরূপ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা কেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সঙ্গে নিবিড় আলোচনা করলেন না, কেন বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে পুরো তালিকাটি অনুপুঙ্খ পর্যালোচনা করলেন না বা পুরো তালিকাটিকে ছোট ছোটভাবে বিভক্ত করে নিখুঁত অংশগুলো পর্যায়ক্রমে প্রকাশ করলেন না, তা পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে না। এরূপ ক্ষেত্রে আন্ত মন্ত্রণালয় আলোচনা (Interministerial Discussion) বাধ্যতামূলক। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তি কি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলেন? ব্যবস্থাপনার মৌলিক জ্ঞানও কি তাঁদের কারো ছিল না? ব্যবস্থাপনা জ্ঞানের এত বিশাল ঘাটতি নিয়ে তাঁরা সরকারের এত উচ্চপর্যায়ে কিভাবে অধিষ্ঠিত হলেন তা ভাবতে গেলে স্তম্ভিত হতে হয়।
এরই মধ্যে আমরা কেরানীগঞ্জ ও গাজীপুরে দুটি কারখানায় ত্রিশের বেশি শ্রমিককে আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যেতে দেখেছি। কী ভয়াবহ ঘটনা! দুটি কারখানার একটিতেও অগ্নি ঝুঁকি মোকাবেলার ব্যবস্থা ছিল না। শ্রমিকদের যেন ইচ্ছাকৃতভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হচ্ছে দুটি কারখানা কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমোদন ছাড়াই উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছিল। যেকোনো বুদ্ধিমান লোক অবাক হয়ে প্রশ্ন করবেন এ রকম দুটি নিম্নমানের ঝুঁকিপূর্ণ অনুমোদনহীন কারখানা কিভাবে এত বছর ধরে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছিল। কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে এসব কারখানার খোঁজখবর নেওয়ার কী কোনো লোক ছিল না? থাকলে মনিটরিং সুপারভিশনে ব্যর্থতা ও কর্তব্যে অবহেলার জন্য তাদের জবাবদিহির আওতায় আনার ব্যবস্থা করা হয়নি কেন? সুব্যবস্থাপনার রীতিনীতি মেনে কারখানাগুলো দেখাশোনা ও নিয়মিত পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা গেলে এতগুলো তরুণ প্রাণ ভয়াবহ আগুনের লেলিহান শিখার মুখে ঝরে পড়ত না। ব্যবস্থাপনার অতি সাধারণ নীতি কারখানা দুটির মালিক ও ম্যানেজার মেনে চলেছেন বলে মনে হয় না। এ ঘাটতি প্রশিক্ষণের অভাব কিংবা মূল্যবোধের অবক্ষয় থেকে হতে পারে। আগে দেখা ঘটনা থেকে তাদের হয়তো বা বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে যে আগুনের মতো দৈব-দুর্বিপাকে কেউ পুড়ে মরলে মালিক বা ব্যবস্থাপনা টিমের কাউকে এ জন্য জবাবদিহি করতে হবে না। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও বিচার বিভাগ একে দুর্ঘটনা হিসেবে মেনে নেবে।
রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও ব্যক্তিজীবনে ব্যবস্থাপনার ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে। ব্যবস্থাপনার সাধারণ বা মৌলিক রীতিনীতি, আইন-কানুন শেখা ও প্রয়োগ করাকে অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। এ ব্যাপারে অবজ্ঞায় নাক সিটকানো অথবা ভয়ে আঁতকে উঠলে চলবে না। অব্যবস্থাপনা বহু সমস্যার আঁতুড়ঘর। একে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলে এসব সমস্যা অঙ্কুরে বিনষ্ট হবে। মনে রাখতে হবে, অব্যবস্থাপনার সমস্যা অনেকটা অপুষ্টি-সমস্যার মতো। অপুষ্টির সমস্যা শুরু থেকে মারাত্মক হয় না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মনে করে এ সমস্যা বাড়বে না। আপনা-আপনি তা সেরে যাবে। এর জন্য বিশেষ স্বাস্থ্যকর খাওয়াদাওয়া ও সুস্বাস্থ্যের রীতিনীতি মেনে চলার প্রয়োজন নাই। অবজ্ঞা-অবহেলায় সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। একসময়ে স্বাস্থ্য এত খারাপ হয়ে পড়ে যে ব্যক্তি চলাফেরা ও কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তখন নানা ওষুধপথ্যেও বিশেষ কোনো কাজ হয় না। ব্যবস্থাপনার ঘাটতি তেমনি এক জটিল সমস্যা। প্রথম দিকে এর কুপ্রভাব ততটা ধরা পড়ে না, কিন্তু কালক্রমে এর তীব্রতা যেমন বাড়ে তেমনি এর বিস্তৃতিও ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। ব্যবস্থার ঘাটতি পরিদৃষ্ট হলে অঙ্কুরে তাকে বিনষ্ট করতে হয়। সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়।
লেখক : সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান