চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির এক বছর

মহানগর প্রতিবেদক

চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ড
ফাইল ছবি

রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনের এক বছর আগের ট্র্যাজেডির ক্ষত এখনো শুকায়নি। অথচ ওই ভবনের নিচতলা আধা সংস্কার করে একটি দোকান ভাড়া দেওয়া হয়েছে প্লাস্টিক তৈরির কাঁচামাল বিক্রেতাকে।

যে কারণে অগ্নিকাণ্ড, এত প্রাণহানী তা যেন লালন করে ওই এলাকার মানুষ। অবশ্য এর পেছনে রয়েছে মোটা অঙ্কের আর্থিক কারণ। এ যেন টাকার কাছে মাথা নুইয়ে স্বেচ্ছায় আত্মাহুতি দেওয়ার মতো।

ওয়াহেদ ম্যানশন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রাসায়নিক পদার্থ, প্লাস্টিকের কাঁচামালে সয়লাব পুরো এলাকা। সরু গলিগুলোর দোকানে দোকানে প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে রাসায়নিক ও বিভিন্ন কাঁচামাল; আগুনের স্পর্শ পেলেই এগুলো হতে পারে এক একটি ভয়ঙ্কর বিস্ফোরক। আবারো কেড়ে নিতে পারে কোনো মায়ের কোল, পিতৃহারা হতে পারে কোনো সন্তান।

বেশিরভাগ আবাসিক ভবনগুলোর নিচতলার সামনের অংশের দোকানগুলোতে প্লাস্টিক কাঁচামালের দানা, বিভিন্ন কেমিক্যালের বিক্রির দোকান। একটু ভেতরেই তরল রাসায়নিকের গোডাউন। কোনো নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার ছাড়াই কর্মীরা সেগুলো ভেতরে-বাহিরে আনা নেওয়া করছেন।

অথচ, ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের পর দাবি উঠেছিল পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন, প্লাস্টিকের কাঁচামাল সরিয়ে অন্যত্র নেওয়ার। দাবির প্রেক্ষিতে কিছুদিন সরব ছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, বিস্ফোরক অধিদপ্তর। ঘটা করে আয়োজন করে অভিযান চালিয়েছিল তারা।

এরপর চিরায়িত নিয়মে প্রশাসনের নিরবতা আর সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ীদের সরব উপস্থিতিতে চকবাজারে ফিরে আসে পুরনো রূপে। ভবনে ভবনে জমতে শুরু করে কেমিক্যাল গোডাউন।

তবে, চকবাজারের ভবনে ভবনে কেমিক্যাল ও প্লাস্টিক কাঁচামালের গোডাউন দেখে বেশি কষ্ট পান ওয়াহেদ ম্যানশনে লাগা আগুনে হাতাহতদের স্বজনরা।

তাদের মতে, সরকারের উদাসীনতা এবং এলাকার লোকদের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল, প্লাস্টিক কাঁচামাল এখান থেকে সরানো সম্ভব হচ্ছে না। নিমতলী ট্র্যাজেডির পর সচেতন হলে ওয়াহেদ ম্যানশনে আগুন লাগত না। আবার কয়েক বছর পর এই কেমিক্যালের কারণে যে বড় ধরনের দুর্ঘটনা হবে না তারও নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না।

স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, চকবাজারসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে পুরাতন ভবন হওয়ার কারণে ভাড়াটিয়ারা থাকতে চান না। এর বিপরীতে কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের ঘর ভাড়া দেওয়া হলে জামানত এবং মাসে মাসে বড় অঙ্কের ভাড়া পাওয়া যায়। যে টাকা  পাওয়া যায় তার অর্ধেক পরিমাণ টাকাও আবাসিক ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে পাওয়া যায় না। ফলে কেমিক্যালের ঝুঁকি জেনেও বাড়ির মালিকরা ব্যবসায়ীদের ঘর ভাড়া দেন।

চকবাজার এলাকার বাসিন্দা ওবায়দুল হক বলেন, সবাই জানে এগুলো বিপদজনক। তারপরও জায়গা দেয়। কারণ একটাই, বেশি ভাড়া। না হলে কেউ মৃত্যু দাওয়াত দিয়ে ঘরে আনে! তাদের ধারণা, দুর্ঘটনাতো আর নিয়মিত হয় না।

ওয়াহেদ ম্যানশনের আগুনে নিহত ওয়াসির উদ্দীনের বাবা নাসির উদ্দীন বলেন, নিমতলীতে আগুন লাগার পর কেমিক্যাল গোডাউনগুলো সরিয়ে নিলে এখানে আগুন লাগত না। এখানো সরকার চাইলেই কেমিক্যাল গোডাউনগুলো সরিয়ে নিতে পারে। এগুলোর জন্য আলাদা এলাকা করে দেওয়া হোক। পাশেই আরমানিটোলা। সেখান থেকে ৫-১০ মিনিটের দূরত্বে নদী। ওখানেও নিতে পারে। ওই এলাকায় যদি আগুন লাগেও তাৎক্ষণিক তা নিবারণ সম্ভব। কারণ নদী থেকে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যাবে। অথচ প্রশাসন এটি করছে না।

তিনি আরো বলেন, শুধু প্রশাসনকে দায় দিলে ভুল হবে। আমি পুরান ঢাকার বাসিন্দা। এখানের লোকজন ঝুঁকির কথা জেনেই ভাড়া দেওয়া হয়। জেনেশুনে বিষপানের মতো। কারণ কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা বেশি ভাড়া দেয়। জামানতও বেশি। আবার রুচিশীল ভাড়াটিয়ারা পুরাতন ভবনগুলোতে ভাড়ায় থাকতে চায় না। ফলে বাড়ির মালিকরা আয়ের কথা চিন্তা করে জীবনের কথা ভাবেই না।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে