আশা, ষড়যন্ত্র, মুক্তির জন্য যুদ্ধ ও মার্চ মাস

আবদুল মান্নান

আবদুল মান্নান
আবদুল মান্নান। ফাইল ছবি

শুরু হলো বাংলার ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় মাস মার্চ। এই মার্চের ২৬ তারিখ বাঙালির স্বাধীনতার ৪৯ বছর পার হবে। আগামী বছর এই মার্চে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তী পালিত হবে। এই মার্চে পালিত হচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মের ১০০ বছর, মুজিব শতবর্ষ। মার্চের প্রথম দিনেই স্মরণ করছি ৩০ লাখ শহীদ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতা আর তিন লাখ মা-বোনকে, যাঁদের রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে এই স্বাধীন বাংলাদেশ। ৪৯ বছর আগে বা তারও আগের বছর ১৯৭০ সালে ফিরে যাওয়াটা আমাদের প্রজন্মের জন্য এক রোমাঞ্চকর পেছনে ফিরে দেখা। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু যখন আগারতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিয়ে কারাগারে তখন বাংলার দামাল ছেলেরা এই উত্তাল গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্ত করে তাঁকে ঘোষণা করলেন বাংলার বন্ধু—বঙ্গবন্ধু। শুধু বাংলার দামাল ছেলেরা নয়, সাধারণ জনগণও বুঝে গিয়েছিল পাকিস্তানের ২৩ বছরের শোষণ-বঞ্চনা থেকে বাঙালিকে মুক্ত করতে পারে একমাত্র বঙ্গবন্ধু আর তাঁর দল আওয়ামী লীগ। পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনামলে এই একজন মানুষই বাঙালির অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, প্রায় ১৪ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। তিনি একমাত্র মানুষ, যিনি বিনা দ্বিধায় বলতে পারতেন, ‘আমি ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করি না, বাঙালির অধিকার আদায়ের জন্য রাজনীতি করি।’ তিনি এমন এক বিরল রাজনৈতিক নেতা ছিলেন, যিনি রাজপথ থেকে উঠে এসেছিলেন। তিনি রাজপথের মানুষের ভাষা বুঝতেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হওয়ার পর ২৫ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের আরেক জোনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইয়াহিয়া ক্ষমতা দখল করে ঘোষণা করেন, ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যার ভিত্তিতে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং নির্বাচিত সংসদীয় প্রতিনিধিদের কাজ হবে পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করা। পূর্ব পাকিস্তানে সেই নির্বাচনটি দুই দফায় হয়েছিল। কারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর পূর্ববঙ্গে এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে প্রায় ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এবং দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। প্রথম দফার নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর আর দক্ষিণবঙ্গের ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোতে হয় ১৭ ডিসেম্বর। পূর্ববঙ্গের জন্য বরাদ্দকৃত ১৬৯টি আসনের ১৬৭টিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে পাকিস্তানের গণপরিষদের ৩০০টি আসনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। বাঙালির মনে আশা জাগে, এবার বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সরকার গঠন করলে বাঙালির দুঃখের দিনের অবসান ঘটবে।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী আর সামরিক-বেসামরিক আমলারা কখনো চিন্তা করতে পারেননি বাঙালির হাতে পাকিস্তানের শাসনভার যাবে। এবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না। বাঙালি যখন আশায় বুক বেঁধেছিল এবার তাদের সুখের দিন আসবে তখন পাকিস্তানে ইয়াহিয়া ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত কিভাবে বাঙালিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখা যায়। ইয়াহিয়া ঘোষণা করেছিলেন, ৩ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানের গণপরিষদের বৈঠক বসবে। কিন্তু ভুট্টোর ষড়যন্ত্রে ১ মার্চ রেডিওর মাধ্যমে ঘোষণা করা হলো, গণপরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি। বাঙালি বুঝে গিয়েছিল, বাঙালিকে বঞ্চিত করার এটি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর আরেকটি চাল মাত্র। তারপর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ, তারপর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্ববঙ্গে গণহত্যার সূচনা।

৯ মাস এক রক্তাক্ত যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। ১০ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়ে পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরলেন। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করলেন। তিনি আজীবন স্বপ্ন দেখতেন একটি আত্মনির্ভরশীল, অসাম্প্রদায়িক, শোষণ, দুর্নীতি ও দারিদ্র্যমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি মনে করেছিলেন, সদ্যঃস্বাধীন দেশটিকে তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলবেন। কিন্তু শুরু থেকেই তিনি হোঁচট খাওয়া শুরু করলেন সদ্যঃস্বাধীন দেশে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির কারণে। তিনি যে সাড়ে তিন বছর বেঁচে ছিলেন, তিনি তাঁর প্রতিটি বক্তৃতায় বলতেন, দেশটিকে নিজের পায়ের ওপর দাঁড় করাতে তাঁর সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিচ্ছে দেশের দুর্নীতিবাজরা। বলতেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশের সব কিছু শেষ করে দিয়ে গেছে, সব কিছু লুটপাট করে নিয়ে গেছে, রেখে গেছে কিছু চোর। মানুষ পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি।’

এই মার্চ মাসে এখন চিন্তা করার সময় হয়েছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে ৪৫ বছর আগে, এই দীর্ঘ সময় পরে দেশে দুর্নীতি কি কমেছে? সোজা-সরল উত্তর—না, কমেনি বরং তা নানাভাবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রায়ই বলেন, ‘বাংলাদেশে আমাকে ছাড়া সকলকে কেনা যায়।’ তিনি একবিন্দু অসত্য বলেননি। দেশটিকে ঠিক রাখার জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা ক্লান্তিহীন পরিশ্রম করেন। কিন্তু দল আর সরকারের ভেতর আরেকটি মহল আছে, তারা পরিশ্রম করে তাঁর সব পরিশ্রম নস্যাৎ করতে। আর যাঁরা এসব কর্মের সঙ্গে জড়িত তাঁদের তিনি বিশ্বাস করেন, তাঁরা তাঁর অত্যন্ত কাছের মানুষ। বঙ্গবন্ধুও এমন ষড়যন্ত্রকারীদের দ্বারা প্রতারিত হয়েছিলেন। একটি কথা আছে, ‘টাকা দিলে বাঘের দুধও পাওয়া যায়।’ বাংলাদেশে টাকা থাকলে যেকোনো কিছু পাওয়া যায় এবং তা বঙ্গবন্ধুকন্যা থেকে আদায় করে নেওয়ার ধৃষ্টতা দেখান তাঁর কাছের মানুষেরা, তাঁকে অসত্য সব তথ্য দিয়ে।

এই বছর যখন একুশে পদক ঘোষিত হলো তখন একজন আমার কাছে ফোন করে জানতে চাইলেন, পদক পেতে কত টাকা লাগে আর সেই টাকা কাকে দিতে হয়? তাঁর প্রশ্ন শুনে আমি তো স্তম্ভিত। পরে পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকা দেখে মনে হলো ভদ্রলোকের প্রশ্নের মধ্যে কিছুটা হলেও সত্যতা থাকতে পারে। অন্য আরেকজন জানতে চাইলেন, পদকের জন্য বাছাই করার সময় কোনো কোটা পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়া হয় কি না? বলা বাহুল্য, এই ধরনের প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার কাছে নেই। একই ধরনের অবস্থা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক স্বাধীনতা পদকের জন্য বাছাইকৃতদের তালিকা দেখে। এটিতে এমন সব নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, অনেক বিদগ্ধজনের কাছে তাঁদের নাম অজানা। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের মতো মানুষকেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলতে হয়েছে, ‘এঁদের অনেককে তো চিনি না।’ তিনি লিখেছেন, বিখ্যাত গবেষক-প্রবন্ধকার অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম, রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সন্জীদা খাতুন, সাংবাদিক তোয়াব খান, অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কবি মহাদেব সাহা, কবি মোহাম্মদ রফিক, আহমদ রফিক, কামাল লোহানী, সনৎ কুমার সাহাদের মতো মানুষ স্বাধীনতা পদকের জন্য বিবেচিত হন না। আর যাঁদের কর্ম সম্পর্কে কেউ কিছুই জানে না, তাঁরা অনেকেই এসব সম্মানজনক পদকের জন্য বিবেচিত হন। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম হঠাৎ তিনি এসব বিষয়ে কেন সোচ্চার হলেন? তিনি জানালেন, অনেকে মনে করেন এসব পদক যেসব কমিটিতে বাছাই করা হয় তিনি বোধ হয় সেসব কমিটির সদস্য। তিনি তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আশ্রয় নিয়েছেন। কারা এসব কমিটিতে থাকেন জানি না, তবে তা যদি হয় আমলানির্ভর, তাহলে আগামী দিনে ভালো কিছু আশা করা যায় না। অনেকে মনে করেন, এসব অনভিপ্রেত কর্মকাণ্ডের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকার তথা বঙ্গবন্ধুকন্যাকে বিব্রত করা। অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড হলেও অনেকে আশ্চর্য হবেন না।

এই মার্চে অঙ্গীকার হোক, বাংলাদেশ যখন তার সুবর্ণ জয়ন্তী উদ্‌যাপন করবে, দেশটি দুর্নীতিমুক্ত হবে। দেশে আর কোনো সম্রাট আর পাপিয়ার দৌরাত্ম্য দেখা যাবে না। আর রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মাননা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠবে না। আর বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছে সবিনয়ে নিবেদন, সরকার বা আপনার কর্মকাণ্ডকে যাঁরা প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেষ্টা করেন, হয়তো হাত বাড়ালেই আপনি তাঁদের ছুঁতে পারবেন। দেশের মানুষে মনে করে, আপনার পিতা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা আপনাকে দিয়েই বাস্তবায়ন সম্ভব।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে