দেশের ৮ বিভাগের ৬৪ জেলায় কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় হাসপাতাল নির্দিষ্ট করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এর মধ্যে ৪৭ জেলায় কোনো আইসিইউ ইউনিট নেই। ১৭ জেলায় আছে ১৭৩টি আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) শয্যা আছে।
তবে ওই ৪৭ জেলায় করোনা আক্রান্ত কোনো রোগীর ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের সাপোর্ট প্রয়োজন হলে দেয়া সম্ভব হবে না। তাদের অন্য জেলা বা রাজধানীতে নিয়ে আসতে হবে। ঢাকায় সরকারি পর্যায়ের ৯টি হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ৩১৯০টি।
এসব হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা আছে ১৪৭টি। ঢাকায় বেসরকারি পর্যায়ে ৬টি হাসপাতাল কোভিড-১৯ চিকিৎসায় যুক্ত রয়েছে। এগুলোয় শয্যা সংখ্যা ৭৫৪টি এবং আইসিইউ শয্যা রয়েছে ২১টি। করোনা প্রতিরোধে এই প্রস্তুতিকে যথেষ্ট মনে করছে না এ সংক্রান্ত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি।
এদিকে দেশের বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যেই রোগতত্ত্ববিদ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা করোনা বিস্তারের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়ের কথা শোনাচ্ছেন। তাদের মতে, আগামী ৩১ মে পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সর্বনিম্ন ৫০ হাজার এবং সর্বোচ্চ ১ লাখ হতে পারে। এই সময়ে করোনায় মৃতের সংখ্যা হতে পারে ৮০০ থেকে ১ হাজার।
গত ২১ এপ্রিল স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সভাপতিত্বে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ ও প্রতিকারে গৃহীত কার্যক্রম পর্যালোচনা ও পরবর্তী করণীয় বিষয়ে সভার কার্যবিবরণীতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ ভবিষ্যৎ প্রক্ষেপণের তথ্য তুলে ধরেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক জানান, করোনা ভাইরাসে লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। এমন খারাপ পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে সর্বোচ্চ সক্ষমতা অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে। তবে এসব সিনারিও মডেলিংয়ে অনেকগুলো ফ্যাক্টর বিবেচনা ও ব্যবহার করা হয়েছে।
যেমন : লকডাউন, জনসচেতনতা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা ইত্যাদি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চিকিৎসা নির্দেশনা অনুসারে আক্রান্তদের মধ্যে ২০ শতাংশ রোগীর হাসপাতালে সেবার প্রয়োজন পড়ে বলে তিনি জানান।
এ প্রসঙ্গে রোগতত্ত্ববিদ ও আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুসতাক হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, উন্নত বিশ্বে এ ধরনের মহামারীর ক্ষেত্রে অনেকগুলো ফ্যাক্টর বিবেচনায় নিয়ে এ ধরনের মডেলিংয়ে করা হয়। এটা আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য নয়। এটা করা হয় মূলত পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য।
গত ২১ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ওই সভায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. আমিনুল জানান, সারা দেশে করোনা রোগীদের হাসপাতাল সুবিধা দেয়ার লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের একটি ম্যাপিং সম্পন্ন করা হয়েছে। সে অনুযায়ী বর্তমানে সরকারিভাবে ৬ হাজার শয্যা প্রস্তুত আছে।
এর ধারাবাহিকতায় সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে সারা দেশে মোট ২০ হাজার শয্যা প্রস্তুত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃত হিসাবে রাজধানীসহ সারা দেশে কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য প্রস্তুতকৃত শয্যা রয়েছে ৯ হাজার ৭৩৮টি। এর মধ্যে আইসিইউ শয্যা রয়েছে ৩৪১টি।
অধিদফতর থেকে তৈরি সারা দেশের হাসপাতালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ঢাকা বিভাগের ১৩ জেলায় (ঢাকা সিটি ব্যতীত) সরকারি পর্যায়ে হাসপাতাল শয্যা সংখ্যা আছে ১০৯৬টি এবং আইসিইউ শয্যা ৪৭টি। এর মধ্যে মানিকগঞ্জ, শরীয়তপুর, টাঙ্গাইল, নরসিংদী, রাজবাড়ী এবং ঢাকার জিনজিরা উপজেলায় নির্ধারিত কোভিড হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা নেই।
চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলায় কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় শয্যা প্রস্তুত রয়েছে ১০৯৮টি এবং আইসিইউ শয্যা ৩৪টি। এর মধ্যে খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, ফেনী, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কক্সবাজার, বান্দরবান, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলায় কোনো আইসিইউ শয্যা নেই।
ময়মনসিংহ বিভাগের ৪টি জেলায় কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য নির্ধারিত শয্যা ৩৮০টি। এর মধ্যে আইসিইউ শয্যা রয়েছে ৭টি। এই বিভাগের নেত্রকোনা, জামালপুর ও শেরপুরে কোনো আইসিইউ শয্যা নেই।
বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য মোট শয্যা ৪১৩টি। এর মধ্যে আইসিইউ শয্যা প্রস্তুত রয়েছে ১৬টি। তবে এই বিভাগের ভোলা, ঝালকাঠি, বরগুনা, পটুয়াখালী ও পিরোজপুর জেলায় কোনো আইসিইউ শয্যা নেই।
সিলেট বিভাগের ৪টি জেলায় কোভিড রোগীদের জন্য প্রস্তুতকৃত শয্যা রয়েছে ৩৪৮টি। এর মধ্যে আইসিইউ শয্যা রয়েছে ১৬টি। তবে সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জ জেলায় কোনো আইসিইউ শয্যা নেই।
রাজশাহী বিভাগে কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য প্রস্তুত শয্যা সংখ্যা ৯২৪টি। এর মধ্যে আইসিইউ আছে ২৮টি। এই বিভাগের নাটোর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, জয়পুরহাট, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় কোনো আইসিইউ শয্যা নেই।
খুলনা বিভাগের ১০টি জেলায় কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য প্রস্তুত ৭১৩টি শয্যা। আইসিইউ আছে ১৮টি। এর মধ্যে বাগেরহাট, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, যশোর, নড়াইল এবং মাগুরা জেলায় কোনো আইসিইউ শয্যা প্রস্তুত নেই।
রংপুর বিভাগের ৮ জেলার কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য প্রস্তুত ৮২২ শয্যা। এর মধ্যে আইসিইউ শয্যা রয়েছে ১৩টি। তবে বিভাগের কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, গাইবান্ধা জেলায় কোনো আইসিইউ শয্যা নেই কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য।
অধিদফতরের তথ্যমতে, রাজধানীতে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার্থে সরকারি পর্যায়ে ৯টি হাসপাতালে মোট ৩১৯০টি শয্যা রয়েছে। এসব হাসপাতালে মুমূর্ষু রোগীদের জন্য আইসিইউ শয্যা আছে ১৪৭টি এবং ডায়ালিসিসের জন্য শয্যা রয়েছে ১০১টি।
পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে করোনা রোগীদের চিকিৎসার্থে শয্যা রয়েছে ৭৫৪টি, আইসিইউ রয়েছে ২১টি এবং ডায়ালিসিস সুবিধা রয়েছে একটি। অর্থাৎ ঢাকা শহরে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে শয্যা রয়েছে ৩৯৪৪টি, আইসিইউ রয়েছে ১৬৪টি এবং ডায়ালিসিস শয্যা ১০২টি।
তবে অধিদফতরের এই প্রস্তুতি যথেষ্ট মনে করছে না বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি। মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত কমিটির দ্বিতীয় সভায় হাসপাতাল সেবার মান বৃদ্ধির বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন কমিটির সভাপতি ও বিএমডিসির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা।
কমিটির পক্ষে তিনি বলেছেন, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালগুলোকে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্বাচন করাই সমীচীন। অন্য হাসপাতালসমূহে মৃদু থেকে মাঝারিভাবে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য রাখা বাঞ্ছনীয়। হাসপাতালগুলোয় জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ চিকিৎসক থাকতে হবে। স্বাস্থ্যসেবার জন্য নিয়োজিত ওয়ার্ডবয়ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সংখ্যা বাড়িয়ে সেবার মান উন্নত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্যসেবাকর্মী, চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য প্রয়োজনীয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত মানসম্মত সুরক্ষাসামগ্রী, বিশেষত পিপিই, ফেস শিল্ড, গগলস, সু-কভার যথেষ্ট সংখ্যায় সরবরাহ করতে হবে। বিশেষত যারা মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত ও সংক্রমিত হওয়ার বেশি ঝুঁকিতে থাকেন তাদের জন্য রেসপিরেটরি মাস্ক সরবরাহ নিশ্চিত করা দরকার।
কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত হাসপাতালসমূহে অতি প্রয়োজনীয় টেস্টের ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। বিশেষ করে সিবিসি, এসজিপিটি, কিটিনিন, ইলেকট্রোলাইট, সিআরপি, সিকেপি, ট্রপিনিন আই, চেষ্ট এক্স-রে, ইসিজি ইত্যাদি পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ মত ও পথকে বলেন, আমি মনে করি, যে প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে সেটি পর্যাপ্ত। কারণ, আক্রান্ত সবার হাসপাতালে আসার প্রয়োজন নেই। একদিনে অনেক বেশি লোক আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও নেই। খুব কমসংখ্যক মানুষেরই জটিলতা তৈরি হয়। তাই যে প্রস্তুতি নেয়া হয়ছে সেটি যথেষ্ট।
প্রসঙ্গত, গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা ভাইরাস রোগী শনাক্ত হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সম্পর্কিত নিয়মিত অনলাইন হেলথ বুলেটিনের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৭১০৩। এই সময়ে এ রোগে মৃত্যু হয়েছে ১৬৩ জনের এবং এ পর্যন্ত মোট ১৫০ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন।