করোনার ফাঁদে পড়ে থমকে আছে দেশের সমুদ্রাঞ্চলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান। উৎপাদন বণ্টন চুক্তি (পিএসসি) অনুমোদনের পর চলতি বছরের শেষ প্রান্তিকে সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য দরপত্র আহ্বান করার কথা ছিল পেট্রোবাংলার। কিন্তু বিশ্ব বাজারের জ্বালানি তেলের অব্যাহত দরপতনে কোনো কোম্পানি এখন এ কাজে এগিয়ে আসবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বঙ্গোপসাগরে ২০১৭ সালের যে ব্লক মানচিত্র তৈরি করেছিল পেট্রোবাংলা সেখানে দেখা যায় সব মিলিয়ে ব্লক রয়েছে ২৬টি। এর মধ্যে অগভীর সমুদ্রে রয়েছে ১১টি আর গভীর সমুদ্রে রয়েছে ১৫টি ব্লক। এর মধ্যে মাত্র চারটি ব্লকে আন্তর্জাতিক তেল গ্যাস অনুসন্ধান উত্তোলনকারী কোম্পানি কাজ করছে। অন্য ২২টি ব্লক একেবারে পড়ে রয়েছে।
দেশের খনিগুলোতে গ্যাসের উৎপাদন কমতে শুরু করেছে। গত জুন পর্যন্ত এক বছরের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমেছে মাসে ৩৫০ মিলিয়ন ঘনমিটারের (এমএসসিএম) ওপরে। হাইড্রোকার্বন ইউনিটের সমীক্ষা এবং পেট্রোবাংলার তথ্য বলছে, নতুন খনি আবিষ্কার না হলে ২০৩০ সাল নাগাদ দৈনিক গ্যাসের উৎপাদন ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের নিচে নেমে আসবে।
ইতোমধ্যে দেশের গ্যাসের ঘাটতি মোকাবিলায় এলএনজি নির্ভরতা বাড়তে শুরু করেছে। দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকার সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধান জোরদার করার চেষ্টা করছিল। সেই প্রচেষ্টাকে জোরদার করতে আগামী সেপ্টেম্বরে পিএসসি আহ্বানের প্রক্রিয়া শুরু করেছে পেট্রোবাংলা।
কিন্তু, অব্যাহত জ্বালানির দরপতনে আন্তর্জাতিক তেল গ্যাস কোম্পানিগুলো বিপাকে রয়েছে। বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দর না বাড়লে সাগরের মতো ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রে তেল গ্যাস অনুসন্ধানকারী কোম্পানি খুঁজে পাওয়া কঠিন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এর আগে ২০০৮ পরবর্তী সময় থেকেও আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের অব্যাহত দরপতনের কারণে বিদেশি কোম্পানিকে পাওয়া যায়নি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
জ্বালানির অব্যাহত দরপতনের মধ্যে পিএসসি আহ্বান করলে কেমন ফল পাওয়া যাবে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক হোসেন মনসুর বলেন, আমরা সাগরের বাড়তি অনেক ব্লক পেলাম। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। বসেই থাকলাম। এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করতে পারলাম না। কেন জানি বসেই থাকলাম। বারবার উদ্যোগ নেওয়া হলো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। এখন আবার শোনা যাচ্ছে চলতি বছর আহ্বান করা হবে। কিন্তু, এই বছর বিশ্বের জ্বালানি খাতের অবস্থা কী হবে, তা এখন দেখার বিষয়।
তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এখন লোকসান গুনতে শুরু করবে। এ অবস্থায় দরপত্র আহ্বান করলে সাড়া খুব বেশি পাওয়া নাও যেতে পারে। আর বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এলেও তারা দর নিশ্চিত কমিয়ে বলবে। কারণ তারা লোকসান গুনছে। সরকারের উচিত হবে সবকিছু বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
এর আগে ২০১১ সালে মার্কিন কোম্পানি কনোকো ফিলিপস গভীর সমুদ্রের ১০ এবং ১১ নম্বর ব্লকে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের চুক্তি করে। এরপর ২০১৩ সালের শেষের দিকে ৭ নম্বর ব্লকে পিএসসি সই করার কথা ছিল কনোকো ফিলিপস এর সঙ্গে। কিন্তু অনেক চেষ্টার পরও কনোকো নতুন ব্লকে পিএসসি সই করতে রাজি হয়নি। এছাড়া পিএসসির বাইরে গিয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে দেন দরবার করে কনোকো। কিন্তু সরকার এতে রাজি না হওয়ায় ২০১৫ সালে গ্যাস ১০ এবং ১১ ব্লক দুটি ছেড়ে দিয়ে যায় মার্কিন এই কোম্পানি।
সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে প্রতিবেশী ভারত এবং মিয়ানমারের চেয়ে পিছিয়ে থেকে এখন পিএসসি আহ্বানে কী হতে পারে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, লোকসান গুনলেও কোম্পানিগুলো কাজ চাইবে। তবে দরের বিষয়টি এখনই বলা সম্ভব নয়। ভালো দর না পাওয়ার শঙ্কা থাকলে কাজ দিয়ে তো কোনও লাভ হবে না।
বর্তমানে অগভীর সমুদ্রে ব্লক-১১টি-তে অস্ট্রেলিয়ার সান্তোস, সিঙ্গাপুরের ক্রিস এনার্জি কাজ করছে। ভারতের প্রতিষ্ঠান ওএনজিসি ভিদেশ লিমিটেড অগভীর সাগরের ৪ এবং ৯ নম্বর ব্লকে কাজ করছে।
অন্যদিকে, বঙ্গোপসাগরের ১২ নম্বর ব্লকে কাজ করছে কোরিয়ান কোম্পানি পোসকো দাইয়ু। এর মধ্যে কোরিয়ান কোম্পানি পোসকো দাইয়ু সম্প্রতি অনুসন্ধান কাজে অংশীদার পাচ্ছে না এমন অজুহাতে চলে যাওয়ার জন্য পেট্রোবাংলাকে জানিয়েছে। তবে পেট্রোবাংলা তাদের অংশীদার অনুসন্ধানে ছয় মাস সময় দিয়েছে।