শ্বেতাঙ্গ বিশ্ব তার বর্ণ-আভিজাত্য প্রকাশে দীর্ঘকাল থেকেই অভ্যস্ত, প্রকাশ্যে ও পরোক্ষে, মূলত সময়ের ধারাবাহিকতায়, আধুনিকতা ও মানবিকতা নামক সামাজিক মূল্যবোধের প্রেক্ষিতে। এর বিশেষ প্রকাশ শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদের উপনিবেশগুলোতে—হোক সেখানকার অধিবাসীরা কৃষ্ণাঙ্গ বা বাদামি বা পীত বা মিশ্র বর্ণের।
মূলত ইউরোপ-অস্ট্রেলিয়া বর্ণবাদী পাপে, অর্থাৎ অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর প্রতি অবজ্ঞা-অবহেলা, ঘৃণার পাপে চিহ্নিত হলেও এর মধ্যমণি যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষভাবে তার দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যগুলো। এর পূর্ব-ইতিহাস বড় জঘন্য, যা বর্বরতার পর্যায়ে পড়ে, যা নিয়ে রবীন্দ্রনাথেরও দেখা গেছে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া, যা তাঁর লেখায় বিশেষভাবে প্রকাশিত। দু-একজন উদারমনা ও মানবিক চেতনার মার্কিন কথাসাহিত্যিকের লেখায় বর্ণবাদের বীভৎস রূপ ধরা পড়েছে।
বিস্ময়কর যে আধুনিক, অত্যাধুনিক যুগে পৌঁছেও মার্কিন সমাজ, প্রশাসন, এমনকি বিচারব্যবস্থা এ পাপ থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি, মুছে ফেলা তো দূরের কথা। অথচ এরই মধ্যে সমাজে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেখা গেছে মূলত দুই ধারার কৃষ্ণাঙ্গদের বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন ও আত্মদানের ফলে।
কিছু মূল ধারায় যে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, যাকে তাৎপর্যপূর্ণ বলা যায়, তার কারণ যুক্তরাষ্ট্রে রক্ষণশীল রাজনীতির প্রাধান্য, প্রাধান্য সমাজে—ব্যক্তিমানসে ও সমষ্টিগত মানসে। কিছুটা উদারপন্থী বা গণতন্ত্রী ধারার ডেমোক্র্যাট রাজনীতি এখানে অসহায় বলা চলে। তাই কখনো দেখা যায় তাদেরও অনুকূল বাতাসে পাল খাটাতে। প্রধানত নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার উদ্দেশ্যে।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যে এখনো বর্ণবাদী পাপে বিদ্ধ, তার প্রমাণ পাওয়া গেল প্রায় বছর পাঁচেক আগে প্রখর শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী বৃহৎ ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী বিজয়ে, প্রধানত শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী বর্ণবাদ উসকে দিয়ে। নির্বাচনে এ বিজয় ছিল অনেকটাই অভাবিত, অনেকেরই হিসাববহির্ভূত। তবু বর্ণবাদের ভূত তাঁকে জিতিয়ে দিল। এ বিজয় খোদ রিপাবলিকান নেতৃত্বের বিচারেও খুব একটা প্রত্যাশিত ছিল না।
গত পাঁচ বছরে ট্রাম্পের শাসন-বৈশিষ্ট্য ছিল বর্ণবাদ ও যুদ্ধবাদী আগ্রাসন ও জিওনিস্ট (ইহুদিবাদী) তোষণের মতো ঘটনাবলিতে পূর্ণ। সেই সঙ্গে অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহার, যে জন্য তাঁকে ইমপিচমেন্টের (অপসারণের) কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। রাজনৈতিক স্বার্থে রিপাবলিকান নেতৃত্ব তাঁর পক্ষে পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
কিন্তু স্বভাব না যায় মলে। যায়নি ট্রাম্পেরও উল্লিখিত রাজনৈতিক অবমাননা সত্ত্বেও। তাঁর নৈরাজ্যিক শাসনের প্রকাশ দেখা গেল করোনা মহামারির সময় গৃহীত নীতিতে—জীবনের চেয়ে অর্থনীতি অনেক বড় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে। আর তা নিয়ে কী যে সমালোচনা।
দুই.
এবার আমরা প্রাসঙ্গিক ধারাবাহিকতায় মূল বিষয়ে আসি। আমরা আগেই বলেছি, অত্যাধুনিক যুগে পৌঁছেও যুক্তরাষ্ট্র সর্বমাত্রায়—সমাজ, প্রশাসন, বিচার বিভাগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বর্ণবাদী পাপ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। উন্নত, সভ্য দেশের নাগরিকদের সুবিচারের শেষ আশ্রয় আদালত। আশ্চর্য! যুক্তরাষ্ট্রে সেখানেও শর্ষের মধ্যে ভূত। সেখানে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক হত্যার সুবিচার হয় না। বেকসুর খালাস পায় পুলিশ।
তাই কৃষ্ণাঙ্গ হত্যায় সে বেপরোয়া—যুক্তিহীন ধারায় মারে গুলিতে বা বীভৎস প্রক্রিয়ার উৎপড়ীনে। বছর কয় আগেকার শ্বেতাঙ্গ পুলিশের এজাতীয় কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ বা যুবক হত্যার ঘটনা পড়েছি সংবাদপত্রে, যেখানে মৃতদের পরিবার আদালতে সুবিচার পায়নি। আমার ঘনিষ্ঠজন বেশ কারো কারো ধারণা, মার্কিনদের এজাতীয় পাপ থেকে মুক্ত হতে আরো দীর্ঘ সময় লেগে যাবে, কারো মতে শতকখানেক।
কিন্তু এরই মধ্যে মার্কিন সমাজে নিঃশব্দে, নীরবে কিছু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাদের প্রবল পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মার্কিন তরুণদের বিদ্রোহ—আসলে ব্যাপক আন্দোলন, বলতে হয় উদ্দাম তারুণ্যের। স্লোগান সবারই মুখে উচ্চারিত—‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’। অর্থাৎ ‘ধনাগার দখল করো।’
যুক্তরাষ্ট্রের ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার কেন্দ্রস্থল নিউ ইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটস্থ কোষাগার, যা মূলত ইহুদি ধনিক শ্রেণি দ্বারা পরিচালিত। যোগ্য ও দক্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবে তরুণদের বিশালায়তন আন্দোলন যা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল, এমনকি মহাসাগর পার হয়ে তাত্ক্ষণিক তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কিন্তু কোনো আন্দোলনই ফলহীন নয়। এর অন্তর্নিহিত প্রভাব সমাজে নিঃশব্দে কাজ করে। পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট রচনা করে।
এরই মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে অবিচার অনাচারের ঘটনা যে ঘটেনি তা-ও নয়। যদিও আমরা জানি, মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ সমাজ মহামতী প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের মানবিক সহৃদয়তায় দাসপ্রথার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে, সময়ের ধারাবাহিকতায় শিক্ষায় ও কিছুটা অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর হয়েছে। তা না হলে কলিন পাওয়েলের মতো কৃষ্ণাঙ্গের পক্ষে জেনারেল পদে উন্নীত হওয়া সম্ভব ছিল? কিংবা বারাক ওবামার দুই মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচনী বিজয়? তবে বিচার বিভাগে এর প্রতিফলন কতখানি তা আমার জানা নেই।
তিন.
আপাতদৃষ্টিতে যেমন মার্কিন (শ্বেতাঙ্গ) পুলিশ বিভাগ, তেমনি বিচার বিভাগ। কৃষ্ণাঙ্গদের সম্পর্কে তাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটেনি। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করেছি পূর্বোক্ত নীরব, নিঃশব্দ কিছু পরিবর্তন, প্রতীক হিসেবে বলা যায় বার্নি স্যান্ডার্সের দু-একটি অঙ্গরাজ্যে বিজয়। এর মধ্যে করোনার মহা-আক্রমণ এবং ক্রান্তিধর্মী ঘটনা এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাঁটুর চাপের বীভৎসাচারে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডের শোকাবহ মৃত্যু।
মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের শ্বেতাঙ্গ পুলিশের নির্যাতনে এজাতীয় মৃত্যু যতই শোকাবহ হোক—নতুন কোনো ঘটনা নয়। আর এমন ঘটনা দেখে অভ্যস্ত মার্কিন নাগরিকরা—কৃষ্ণাঙ্গ বা শ্বেতাঙ্গ বা মিশ্র বর্ণের। তারা পুলিশের অন্যায্য হত্যায় বিচার বিভাগের যুক্তিহীন আচরণ দেখেও অভ্যস্ত। এসব ঘটনা সমাজে প্রবল কোনো ঢেউ তুলতে দেখা যায় না। কিন্তু কী হলো এবার?
মনে হলো যেন পেন্টাগনের সামনে কেউ বোমা ফাটিয়েছে, এমন এক বিস্ফোরক প্রতিক্রিয়া ঘটনাস্থল মিনিয়াপলিস///// শহরে। অথচ ফ্রয়েড কোনো খ্যাতিমান রাজনৈতিক নেতা নন, সমাজের বিশিষ্ট গণমান্য কোনো ব্যক্তি নন, কোনো উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তা নন; তিনি একজন সাধারণ মার্কিন নাগরিক। কিন্তু এই বর্বর পুলিশি হত্যাকাণ্ড ও বিচার বিভাগীয় অনীহা শুকনো বারুদে এমন স্ফুলিঙ্গপাত ঘটাল যে তা দাবানলের সৃষ্টি করল—শহর থেকে শহরে এবং অঙ্গরাজ্য থেকে অন্য অঙ্গরাজ্যে, এমনকি মহাসাগর পেরিয়ে তার বিস্তার কানাডা, অস্ট্রেলিয়া হয়ে খাস ইউরোপে, যেখান থেকে বর্ণবাদ পুরোপুরি মুছে যায়নি।
এর মধ্যে আগুনে তেল ঢালা বিক্ষোভ কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ ট্রাম্পের। কারণ তিনি নিজেও তো বর্ণবাদী। নির্দেশ দিয়ে তিনি আপন সুরক্ষায় বাংকারে ঢুকে গেলেন, যাতে বিক্ষুব্ধ জনতা তাঁকে হাতের কাছে না পায়। এদিকে বিক্ষোভকারীরা হাজারে হাজারে গ্রেপ্তার। কিন্তু সহিংস বিক্ষোভ থামছে না, বন্ধ হচ্ছে না ভাঙচুর। বাংলাদেশের একটি দৈনিকে শিরোনাম : ‘বিক্ষোভে হামলার ঘটনায় ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলা’ (৬.৬.২০২০)।
দ্বিতীয় ঘটনা তথা শিরোনামটি আরো চমকপ্রদ। ঘটনাস্থল নিউ ইয়র্কের বাফেলো শহর : ‘বিক্ষোভের মধ্যেই পুলিশের হাতে এক বৃদ্ধ রক্তাক্ত’। বৃদ্ধের বয়স ৭৫। এই হলো মার্কিন পুলিশের চরিত্র। অর্থাৎ ট্রাম্প অনড়। প্রয়োজনে সেনাবাহিনী নামানো হবে। কিন্তু প্রতিরক্ষামন্ত্রী নারাজ পরিস্থিতির পরিণাম ভেবে। কারণ বিক্ষোভ চলছে দেশজুড়ে। ১০ দিন পেরিয়ে গেছে। তাও বিক্ষোভ থামছে না। ট্রাম্পের উসকানিমূলক বক্তব্য—এ মুহূর্তে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদ বিপরীতমুখী। উত্তর-দক্ষিণ একাকার।
বিষয়টি আপন তাৎপর্যে দীর্ঘ আলোচনার দাবি রাখে। আমরা সংক্ষেপে বক্তব্য শেষ করছি। একজন কৃষ্ণাঙ্গ হত্যায় এই যে অবিশ্বাস্য মাত্রায় বর্ণবাদবিরোধী প্রতিবাদ-বিক্ষোভ, তা সমাজে পুঞ্জীভূত দীর্ঘকালীন প্রতিবাদী সচেতনতার আকস্মিক প্রকাশ এবং তা এতটা তীব্রতা ও ব্যাপকতায় যে তা উপনিবেশবাদী ব্রিটেনকেও স্পর্শ করেছে, যদিও সেখানে রক্ষণশীল শাসনব্যবস্থা বর্তমান। বিস্ময়কর ঘটনা হলো, খ্যাতিমান রক্ষণশীল রাজনীতিক চার্চিল ও দাস ব্যবসায়ী ব্লমটনের ভাস্কর্যের ওপর হামলা এবং ক্লাইভের মূর্তি অপসারণের জন্য আবেদন তথা দাবি।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথার জনক কলম্বাসের মূর্তি ভাঙচুর একাধিক শহরে। ট্রাম্প প্রশাসন যে উগ্র মূর্তিতে বিক্ষোভ দমন করে চলেছে, তাতে এ প্রতিবাদ বিক্ষোভও একসময় স্তব্ধ হয়ে যাবে নতুন আরেকটি উপলক্ষের অপেক্ষায়। তবে ব্রিটিশ জনতার উল্লিখিত ক্ষুব্ধ পরিবর্তন তাত্ক্ষণিক হলেও এর তাৎপর্য অনস্বীকার্য। আধিপত্যবাদ, বর্ণবাদ, মানববিদ্বেষী চেতনার বিরুদ্ধে সচেতনতা বিস্ময়কর এ কারণে যে এই জনতাই কিছুদিন আগে একজন রক্ষণশীল, বর্ণবাদীকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। কতজন ফ্লয়েডের মৃত্যু আকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনবে তা-ই এখন দেখার বিষয় কি যুক্তরাজ্যে কি যুক্তরাষ্ট্রে?
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, ভাষাসংগ্রামী।