দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ১৫ বছর আজ সোমবার। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারাদেশে একযোগে বোমা হামলা চালায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)। ওই দিন বেলা সাড়ে ১১টায় দেশের ৬৩ জেলার গুরুত্বপূর্ণ ৪৫০টি স্থানে প্রায় পাঁচশ বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। এই হামলায় নিহত হন দুজন এবং আহত হন দুই শতাধিক ব্যক্তি।
ওই বছরের ১৪ নভেম্বর ঝালকাঠিতে বিচারক বহনকারী গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালায় জঙ্গিরা। এতে নিহত হন ঝালকাঠি জেলা জজ আদালতের বিচারক জগন্নাথ পাড়ে ও সোহেল আহম্মদ।
পুলিশ জানায়, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় সারাদেশে ১৫৯টি মামলার মধ্যে ৯৪টি মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। এসব মামলায় ৩৩৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। এখন ৫৫টি মামলা বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে। যার আসামি সংখ্যা হচ্ছে ৩৮৬ জন। এই সিরিজ বোমা হামলার রায় প্রদান করা মামলাগুলোর ৩৪৯ জনকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। আসামিদের মধ্যে ২৭ জনের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় দেয়া হয়। এরমধ্যে ৮ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। এসব মামলায় খালাস পেয়েছে ৩৫৮ জন আর জামিনে রয়েছে ১৩৩ জন আসামি। এছাড়া ঢাকায় বিচারাধীন ৫টি মামলা সাক্ষ্য গ্রহণের শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
জানা গেছে, সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় সর্বোচ্চ ২৩টি মামলা হয় ঢাকা ও খুলনা রেঞ্জে। সর্বনিম্ন তিনটি করে মামলা হয় খুলনা মহানগর ও রেলওয়ে রেঞ্জে। মহানগরীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয় ঢাকা মহানগর এলাকায় অর্থাৎ, ডিএমপিতে। এখানে ১৮টি মামলা হলেও ৯টি মামলায় পুলিশ চার্জশিট দিয়েছে। এসব মামলার চূড়ান্ত রায়ে ফাঁসি কার্যকর হয় ৯ আসামির। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধেও শতাধিক জঙ্গির করা আপিল বর্তমানে উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
বিচারের অপেক্ষায় আদালতে যেসব মামলা ঝুলে আছে সেজন্য সাক্ষী হাজিরে ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা। তারা বলছেন, বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় অনেক মামলায় এখন সাক্ষী খুঁজে পাওয়া চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে আসামিদের অনেকেই এখন পলাতক। বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধেও ইতোমধ্যে হাইকোর্টে আপিল করেছে আসামিরা। অবশ্য ঝালকাঠিতে দুই বিচারক হত্যা মামলায় ২০০৭ সালের মার্চে জেএমবিপ্রধান শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই, খালেদ সাইফুল্লাহ, আতাউর রহমান সানি, আবদুল আউয়াল ও ইফতেখার হাসান আল মামুনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, সাক্ষী হাজিরে রাষ্ট্রপক্ষের দীর্ঘসূত্রতার কারণেই ৪৭টি মামলার বিচারকাজ এখনও শেষ হয়নি। আদালত থেকে সাক্ষীদের বারবার হাজির হওয়ার সমন দিলেও তা ফেরত আসছে। কারণ বেশিরভাগ সাক্ষীই আদালতের নথিতে উল্লেখিত ঠিকানা পরিবর্তন করেছেন। রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, সাক্ষীদের অনেকে ভীতির মধ্যে রয়েছেন।
জানতে চাইলে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, কারোনার আগে অর্থাৎ, ফেব্রুয়ারিতেও হাইকোর্টে জঙ্গিদের করা ডেথ রেফারেন্স মামলার শুনানি হয়েছে। অনেক আসামির জামিনের আবেদন এবং বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল হাইকোর্টে বিচারাধীন। তবে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় সচেষ্ট রয়েছে।
বিচারিক আদালতে নিষ্পত্তি না হওয়া মামলাগুলো প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল্লাহ আবু বলেন, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অর্থাৎ, পুলিশ যথাসময়ে আদালতে সাক্ষী হাজির করতে পারেননি। আদালত বারবার সময় দিলেও সাক্ষী খুঁজে পাচ্ছেন না বলে দাবি করেছেন তারা। ফলে মামলা নিষ্পত্তিতে ধীরগতি দেখা দিয়েছে।
অবশ্য চাঞ্চল্যকর এই মামলাগুলোর বিচার দেরিতে হলেও শেষ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করতে সরকার বদ্ধপরিকর। দীর্ঘ অপেক্ষার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এই সরকার করেছে।
তিনি আরও বলেন, চাঞ্চল্যকর মামলাগুলো নিষ্পত্তির জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল রয়েছে। তারা সাক্ষী হাজিরসহ বিচারের নানা সংকট নিরসনে সচেষ্ট। যত সময় লাগুক বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে দেশব্যাপী পরিচালিত সিরিজ বোমা হামলার বিচারও হবে।